বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে। জীবনযাত্রার মানের অনেক উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে দেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণীয়। আমরা মধ্য আয়ের দেশে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলেছে দেশ। এসবই আমাদের গর্ব। আমাদের অহংকার।
করোনা মহামারির কারণে অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়লেও এর মাত্রাটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। যদিও করোনার কারণে দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে এবং বেকার হয়েছে প্রায় কয়েক লাখ। একদিকে করোনায় বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি, আয় রোজগার কমে যাওয়া, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতেও অবস্থা এতটা অসহনীয় পর্যায়ে যায়নি বলা যায়। কিন্তু বর্তমানে করোনার প্রকোপ কমার পরও অবস্থার তেমন কোনো অগ্রগতি তো হচ্ছেই না; বরং দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে একটা শ্রেণির জীবনযাত্রা প্রায় অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স স্টাডিজের গবেষণা অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে দেশে ২১ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। করোনার আগে ২০১৭ সালে দরিদ্র মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১১৭ টাকা। প্রথম লকডাউনের পরে এ আয় কমে হয় ৬৫ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ আয় বেড়ে হয়েছিল ১০৫ টাকা। বর্তমানে তা আবার নেমে হয়েছে ৯৯ টাকা। এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত আয় কমেছে ৬ শতাংশ। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মানুষের আয় করোনা—পূর্ব সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ কমে গেছে।
দেশের উন্নয়ন হচ্ছে; কিন্তু এ উন্নয়ন দেখে তো জীবন চলছে না। আমাদের জীবনের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, থমকে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পর্যুদস্ত। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন এক পর্যায়ে চলে এসেছে, যেখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দৈনন্দিন বাজেট কাটছাঁট করতে করতে প্রায় তলানিতে এসে পেঁৗছেছে।
বিগত দুই বছরে অর্থাৎ করোনা শুরুর পর থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এই ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা করোনা কমার পরেও ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে নাগালের বাইরে চলে গেছে। শুধু যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তা নয়; গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পরিবহণ ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয়, শিক্ষার উপকরণ ব্যয় ইত্যাদিও লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সীমিত ও বাঁধা আয়ের মানুষের সংসার আর চলছে না কোনোভাবেই।
খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। বিশেষ করে সৎভাবে চলা অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী শ্রেণি ও প্রবীণ জনগোষ্ঠী পড়েছে উভয় সংকটে। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যসহ জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ যে কতটা কষ্টে, কতটা যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করছে, তা বুঝিয়ে বলা যাচ্ছে না। চালের বাজার এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী ছিল, তারপরও বিগত এক সপ্তাহে মান ও জাতভেদে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ৬ টাকা। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনোভাবেই সমন্বয় করা যাচ্ছে না। আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প ব্যবস্থাও পাওয়া যাচ্ছে না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে পত্রিকার পাতায় প্রতিদিনই বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো মানুষের দুঃখ—দুর্দশার কথা লিখেই চলেছে; কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধসহ বিভিন্ন অজুহাতে মজুতদার, সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতিদিন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেই যাচ্ছে। তারা ভোক্তার পকেট কেটে নিজেদের পকেট ভারি করেই চলেছে।
প্রশ্ন হলো, যেসব পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে না, বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে; সেগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে কিভাবে? ১৭ কোটি মানুষের দেশে ৮০ শতাংশ মানুষই দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির। বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক প্রাপ্ত জরিপ অনুযায়ী, করোনার আঘাতে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া আড়াই কোটি মানুষের দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকার ঋণ কর্মসূচিসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়িয়েছে।
করোনার ধকল কাটিয়ে দেশের শিল্পকারখানা উৎপাদনমুখী হওয়াতে আমদানিতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর এই ৫ মাসের রপ্তানি থেকে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলার আয় হয়েছে এবং এ সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪.২৯ শতাংশ। জানা যায় এর আগের বছর একই সময়ে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৫৯২ কোটি ডলার।
২০২০ সালের শেষদিকে বিবিএস কর্তৃক এক জরিপে দেখা যায়, দেশের মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে গেছে। অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। আয় ও ব্যয়ের এ বিরাট ব্যবধান কিভাবে সমন্বয় করা যায়—এ হিসাব কেউ মেলাতে পারছে না। মাছে ভাতে বাঙালির আজ দৈন্যদশা। মাথাপিছু আয় বেড়ে লাভ কী হয়েছে, কাদের লাভ হয়েছে, মধ্যম আয়ের দেশে গিয়ে কারা লাভবান হবে—এসব আজ বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
ইতোমধ্যে ২০২২—২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হয়েছে। প্রতি বছর বাজেটের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবারের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা পূর্ববর্তী বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩ কোটি টাকা বেশি। এরই মধ্যে সরকার গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে। বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। এসব বৃদ্ধি করা মানে আরেক দফা বাজার গরম করা।
সব মিলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির। বাজারে সরকারি উদ্যোগের প্রভাব লক্ষণীয় নয়। সরকার শক্ত হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা অনুমান করতেও ভয় হচ্ছে।
সরকারকে দ্রুত বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। ব্যাপক আকারে অভিযান চালিয়ে কালোবাজারি, মুনাফাখোর মজুতদারদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সিন্ডিকেটের হোতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সামাজিক অস্থিরতা নাগালের বাইরে চলে যাবে। সমাজে ইতোমধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাটে ছিনতাই, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অরাজকতা বেড়ে গেছে।
মানুষের পেটে ভাত না থাকলে ক্ষুধা নিবারণের জন্য ছিনতাই, রাহাজানিসহ যে কোনো অন্যায়, অপকর্ম সংঘটিত করতে পারে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। এগুলো সরকারের অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিতে পারে।
এবারের বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপর যে জোর দেওয়া হয়েছে, সেটা যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য কর্মসংস্থানের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয় কমাতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হিসাবে যে স্থান করে নিয়েছে, সেটা আমাদের যে কোনো মূল্যেই হোক ধরে রাখতে হবে। কিছুসংখ্যক দুর্নীতিবাজ, নীতিবিবর্জিত মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে অর্জনগুলো যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রেখে পরিবার, সমাজ তথা দেশের কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ||||
৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ |
১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ |
১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ |
২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |