মার্চ মাসে প্রায় শতাধিক ধর্ষণের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে মাগুরার নিষ্পাপ শিশু আছিয়া, যে ২০৪ ঘণ্টা জীবন ও মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে পৃথিবী থেকে চলে গেছে, তার মৃত্যু আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন রেখে গেছে—আমরা কি নারী ও শিশুর নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়েছি? বা, আমরা আসলেই এই বিষয়ে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ? তার মৃত্যুর ফলে সমাজের বেদনা এবং ক্ষোভ প্রকট হয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন ওঠে—আমরা কী সঠিক শিক্ষা নিয়েছি, নাকি বরাবরের মতো রুটিন শোক ও নিন্দা জানিয়ে দায় সেরেছি?
সমাজে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা যে হারে বেড়ে যাচ্ছে, তাতে একে কেবল ‘উদ্বেগজনক’ হিসেবে দেখলে কোনো লাভ নেই। এটি সমাজের জন্য একটি বড় বাধা, যার ফলে সামাজিক অগ্রযাত্রা থমকে যাচ্ছে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের সমাজের নৈতিক অবস্থান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। অতীতে ঘটেছে এমন বহু ঘটনার সত্যিকার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, অপরাধীর মুক্তি, এবং নির্যাতিতাকে সমাজের পক্ষ থেকে দায়ী করার প্রক্রিয়া এসব অপরাধকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ধর্ষণ শুধু যৌন অপরাধ নয়, এটি এক ধরনের বিকৃত যৌন আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ, যেখানে পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। এটি একদিকে নারীর ওপর ক্ষমতার দখলদারিত্বের প্রতিফলন, অন্যদিকে সমাজের গভীরে প্রোথিত লিঙ্গবৈষম্যের প্রকট উদাহরণ। ধর্ষকের মানসিকতা জিঘাংসায় উন্মত্ত, অথচ সে সমাজের ছায়ায় অনায়াসে বিচরণ করে—যেন কিছুই হয়নি। ধর্ষণের পর বিচারের ভাষা বা রেটরিক্সও পুরুষতন্ত্রের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ধর্ষক যদি ফাঁসির রায় পেলেও, কাঠামো কি বদলায়? উত্তর বারবার একই—‘না’। রাষ্ট্র ও সমাজ এ প্রশ্নের সামনে বারবার নতজানু হয়। শাস্তির দাবি যৌক্তিক হলেও, এটিকে একমাত্র সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলে সমস্যার গভীরতর কারণগুলো আড়ালে থেকে যায়। আছিয়ার মৃত্যুর শোকে মুহ্যমান হওয়ার বদলে যদি আমরা এটি একটি শক্তিতে পরিণত করতে পারি, নারী ও শিশুর প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ পরিবর্তন করতে পারি, এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারি, তবে ভবিষ্যতে এমন মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিরোধ সম্ভব হবে। রাষ্ট্রের দায় যেমন রয়েছে, তেমনি প্রতিটি নাগরিককেও দায়িত্ব নিতে হবে।
দেশে বর্তমানে এক অস্বস্তিকর অস্থিরতা বিরাজ করছে, যেখানে অনেকেই এক ধরনের গুমোট পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছেন। একজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতার ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর তৈরি হওয়া পরিস্থিতি দেশজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে। এই বক্তব্য কিছুটা সংক্ষুব্ধতা সৃষ্টি করলেও, তার পরিণতিতে যদি সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তা দেশ ও জাতির জন্য দুঃখজনক হবে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে আমাদের সামনে। তবে এই অভ্যুত্থানে অন্তত দেড় হাজার প্রাণ ঝরে গেছে এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব এই রক্তপাত বৃথা যেতে না দেওয়া এবং ঐক্য ধরে রেখে দেশের উন্নতি নিশ্চিত করা। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত একটি ঐকমত্যে পৌঁছাবে, বিশেষত নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয় নিয়ে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও সন্তোষজনক নয় এবং পুলিশ বাহিনীর মনোবল এখনও পুনরুদ্ধার হয়নি। মনে করা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য সরকারকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করছে না, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায়, কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর মনোবল ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেলেও, তাদের উপস্থিতি ও কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। তাই, নাগরিক সমাজের দেশপ্রেমমূলক মনোভাবই একমাত্র পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে।
দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একটি অসাধারণ সৃজনশীল নোবেলবিজয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তার দক্ষতার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে, ছাত্রসমাজের সহায়তা প্রয়োজন। ছাত্রসমাজ এই দেশের ঐক্যবদ্ধ শক্তি, এবং যদি তারা সঠিক পথে থাকে, তাহলে অনেক কিছুই অর্জন করা সম্ভব। রাজনৈতিক দল এবং দেশের নাগরিক সমাজের শুভচিন্তাই পারে দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে। প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টামণ্ডলী এককভাবে এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, তাই আমাদের প্রত্যেকেরই সুনাগরিক হয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
ক্যালেন্ডারের পালাবদলে আরেকটি বাংলা সনের আগমন ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত মঙ্গল শোভাযাত্রার এবারের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে “নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান।” এবারের শোভাযাত্রাটিতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী যেমন চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারোসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ও অংশ নেবে। এটি শুধু বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে আরও সমৃদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধভাবে উদযাপন করার লক্ষ্য রাখা হয়েছে। নতুন বছরে আমাদেরও প্রত্যাশা থাকবে, জাত-ধর্মের শৃঙ্খল ফেলে ঝেড়ে, অশুভ যাক উড়ে কালবৈশাখী ঝড়ে; নিপাত যাক বীজ সাম্প্রদায়িকতার। আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে উদ্ভাষিত হোক ধরা।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?