clock ,

পাকিস্তানে পানি বন্ধ করার সক্ষমতা নেই ভারতের

পাকিস্তানে পানি বন্ধ করার সক্ষমতা নেই ভারতের

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে সিন্ধু নদ থেকে একটি ক্যানেল সেচব্যবস্থা নির্মাণকে কেন্দ্র করে দেশটিতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তীব্র বিতর্ক চলছে। মূলত চোলিস্তানের শুষ্ক এলাকাকে চাষাবাদের উপযোগী করার জন্য এই ক্যানেল তৈরি হচ্ছে।

দেশটির বিভিন্ন মহল এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, লেখক, আইনজীবীসহ সিন্ধুর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন। বেশ কিছুদিন ধরে সিন্ধু-পাঞ্জাব সীমান্ত বন্ধ রয়েছে এবং সরকারের কাছে এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়ে আন্দোলনকারীরা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। 

ঠিক এমন সময়েই নতুন খবরসেই সিন্ধু নদের পানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে ভারত। দেশটি ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে করাসিন্ধু পানি চুক্তিস্থগিত করেছে।  মূলত পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার দায় পাকিস্তানের ওপর চাপাতেই চুক্তি স্থগিত করে মোদি সরকার। তবে বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক আইন এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে ভারতের পক্ষে পাকিস্তানের পানি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়।

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।  চুক্তিটির গ্যারান্টার বিশ্বব্যাংক।  ১৯৬৫, ১৯৭১ ১৯৯৯ সালে পাক-ভারত যুদ্ধেও চুক্তি বাতিল হয়নি। কাজেই চুক্তি স্থগিতের ঘোষণাটি আসলে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য এক ধরনের কৌশল, যার উদ্দেশ্য জনমতকে খুশি করা। কিন্তু যদি ভারত সত্যিই পাকিস্তানের পানি বন্ধ করে, তাহলে এর ফলে পাকিস্তানে কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মোদি সরকার ২০১৯ সালেও একই ধরনের হুমকি দিয়েছিল। তখন যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পানি বন্ধের কথা বলা হয়েছিল, এবারও তেমনটাই করছে। অথচ সিন্ধু পানি চুক্তি অনুযায়ী শুধু সতলজ, বিয়াস রাভিএই তিনটি নদী ভারতের জন্য নির্দিষ্ট এবং এগুলো ভারতের একচেটিয়া ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ।

কিন্তু ভারতের পরিকাঠামো এখনও এত উন্নত নয় যে তারা তাদের নিজস্ব ভাগের পানি পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারে। ফলে এই পানি স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়ে যায় এবং একে থামানোর বাস্তব ক্ষমতা ভারতের নেই। এর চেয়েও বড় কথা, চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত নদীগুলো (সিন্ধু, ঝেলাম চেনাব) ভারত একতরফাভাবে বন্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না। এমন প্রকল্প নির্মাণ করতে গেলে ভারতের দশকের পর দশক লেগে যাবে।

ভারত থেকে পাকিস্তানে মোট ছয়টি নদী প্রবাহিত হয়; যার মধ্যে তিনটি নদীর পানি ভারতে তিনটি নদীর পানি পাকিস্তানকে একতরফাভাবে ব্যবহার করতে পারে। তবে ভারত অতীতেও এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। 

৯০ দশকে দোদা জেলায় চেনাব নদীর উপর একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে ভারত, যা সরাসরি পাকিস্তানের পানির ভাগে প্রভাব ফেলে। তেমনি কিশানগঙ্গা নদীতে বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণও আন্তর্জাতিক আইন সিন্ধু চুক্তির লঙ্ঘন।

আন্তর্জাতিক আইন মতে, যেকোনো আন্তঃদেশীয় নদী ব্যবহারেন্যায্য এবং যুক্তিসংগতব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ১৯১১ সালের মাদ্রিদ ঘোষণা পরবর্তীতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জলপথ ব্যবহারের চুক্তি এই নীতিকে সমর্থন করে। অর্থাৎ, একটি দেশ অপর দেশের অনুমতি ছাড়া কোনো নদীর প্রবাহে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

তাই পাকিস্তানে ভারতের এই পানি বন্ধ করা শুধু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ নয়, এটি কূটনৈতিকভাবেও আত্মঘাতী পদক্ষেপ হবে। পাশাপাশি বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো২০১৬ সালে উরি হামলার পর ভারত যখন পানি বন্ধের হুমকি দিয়েছিল, তখন চীন তিব্বতের ব্রহ্মপুত্র নদীর একটি শাখা নদী বন্ধ করে দেয়। এতে ভারতের পানিপ্রবাহও ব্যাহত হয়। তখন ভারতের প্রতিক্রিয়া অনেকটা নীরব ছিল, কারণ চীনের বিরুদ্ধে কিছু বলার অবস্থায় তারা ছিল না। এখন যদি ভারত পাকিস্তানের পানি বন্ধের চেষ্টা করে, তাহলে ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করার নৈতিক ভিত্তি তারা হারাবে।

ভারত পাকিস্তান উভয়ই কৃষিনির্ভর দেশ। পানিসংকট সৃষ্টি হলে শুধু পাকিস্তান নয়, ভারতের কৃষিও বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। তাই শুধু আন্তর্জাতিক আইন নয়, নিজেদের স্বার্থেই ভারতের উচিত সিন্ধু পানি চুক্তিকে সম্মান জানানো শর্তগুলো মেনে চলার। 

ভারতের পক্ষে এই চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল করা যেমন আইনি ভিত্তিহীন, তেমনি তারা এখনো এমন কোনো পরিকাঠামো তৈরি করতে পারেনি যার মাধ্যমে পাকিস্তানের পানিপ্রবাহ থামানো সম্ভব। তাই বলা যায়ভারতের পক্ষে পাকিস্তানের পানি বন্ধ করা আদৌ সম্ভব নয়, আর এমনটা করলে তার ফল ভোগ করতে হবে ভারতকেই।

অনুবাদ: খালিদ হাসান

পাকিস্তানি অভিনেতা, পরিচালক শিক্ষাবিদ

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য