মানুষের কান্নাগুলো তার স্বপ্নের মতো দামী। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই মানুষ তার জীবনকে বাজি ধরে। স্বপ্ন পূরণ হলেও অনেক সময় মানুষ আনন্দের আতিশয্যে কেঁদে ফেলে। অন্যদিকে স্বপ্ন ভঙ্গ হলে তো কথাই নেই-মানুষকে হতাশার গ্লানি নিয়ে সারাটাজীবনই কেঁদে চলতে হয়। কান্না হাসির এই অমীমাংসিত নিয়ম মেনেই পৃথিবী তার আপন কক্ষপথে ঘুরে চলছে। মানুষ কখনো কখনো তার কান্নাকে লুকিয়ে রাখতে চায়। হয়তো অন্য কারো মুখকে ভেবে দায়িত্বের বোঝা টেনে টেনে; কিংবা প্রিয় কোনো মুখে একচিলতে হাসি ধরে রাখার জন্য। হ্যাঁ, রাশেদ তেমনি এক প্রতিশ্রুতি নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইয়ে। যেখানে নানান দেশের অচেনা অজানা মানুষের হুড়োহুড়ি। প্রথম অবস্থায় সেখানকার ভাষা সংস্কৃতি সবকিছুই তার অজানা। আজ সে এমন এক ভিনদেশের ভিন্ন পথের পথিক। যেখানে প্রতিটি মানুষই জীবনকে বাজি ধরার খেলায় মত্ত। শ্রমই এখানে মানদণ্ডের একমাত্র মাপকাঠি। আজ তার একমাত্র পরিচয় সে ‘‘শ্রমিক’’।
রাশেদের নামের পাশে বাংলাদেশ সরকার এখন দায়িত্বের সাথে ‘রেমিটেন্স যোদ্ধা’—এর তকমা জুড়ে দিয়েছে। আর মা বাবা ভাই—বোনের কাছে তার পরিচয় হয়ে গেছে ‘বেঁচে থাকার অবলম্বন; ভালো থাকার একমাত্র উপায়’। আর ভালোবাসার মানুষ নিশিতার কাছে সে ছিল ‘ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের কাঙ্খিত পুরুষ’। রাশেদের বাবা এনায়েত মাস্টার। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বেতনের মধ্যে থেকেই চাহিদা পূরণে অভ্যস্ত। স্বচ্ছ আয় স্বচ্ছ জীবনÑএটাই ছিল তাঁর শ্লোগান। ভালোই চলছিল। ছেলেমেয়েদের ভালো কিছু করার প্রত্যয়ে সম্প্রতি কয়েকটি টিউশনিও করছেন। রাশেদ তখন মুকসুদপুর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। মানবিক বিভাগ থেকে ‘এ প্লাস’। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। শিক্ষক, সহপাঠীদের প্রত্যাশাও ছিল বেশ। স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো সাবজেক্টে ভর্তি হবে। ভবিষ্যতে ভালো চাকরি করবে। কিন্তু সময়ের পালা বদলে স্বয়ং বিধাতাই যখন কারো প্রতিপক্ষ হয়ে যান, সেখানে তাঁর হাতে গড়া পৃথিবীর এমন দুর্বোধ্য নিয়ম—কানুন তো সবসময় তার পক্ষেই কথা বলবেÑতাই না? বিধাতার এমন—ই এক নির্দয়তার মুখোমুখি আজ এই নবীন যুবাÑরাশেদ। একদিন স্কুল চলাকালীন অবস্থায় রাশেদের বাবা এনায়েত মুন্সি বুকের বাম দিকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করেন। প্রাথমিক অবস্থায় গ্যাসের ব্যথা মনে করেছিল। গ্রামের হরিপদ ডাক্তার ওষুধ দিলেও কোনো কাজ হয় নি। অবস্থার অবনতি হলে গোপালগঞ্জ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। নানাবিধ পরীক্ষা শেষে জানা গেল স্ট্রোক করেছেন। ডাক্তার প্রবীর কুমার ব্যানার্জীর পরামর্শে তাকে দ্রুত ঢাকার বক্ষব্যধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রায় এক দেড় মাস চিকিৎসা শেষে বেঁচে রইলেন। তবে নিশ্চল, ডান দিকটা পুরো অবশ। পুঁজি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ব্যাংক একাউন্টে জমে থাকা কুড়ি হাজার সাত’শ ছিয়াত্তর টাকা ও পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া একবিঘা জমির পুরোটা দিয়েই চিকিৎসা।
এনায়েত মুন্সির এমন অবস্থায় ভাগ্য বিপর্যয়ের এক অস্থির কালো ছায়া অনায়াসেই রাশেদকে গ্রাস করে ফেলে। সহায় সম্বলহীন এই পরিবারটায় রাশেদই এখন একমাত্র অবলম্বন। অথচ সে উপায়হীন। ছোট ভাই রাফি সামনের বছর কলেজে যাবে, ছোট বোন রোখসানা হাইস্কুলে পড়ে। তাদের পড়াশুনার খরচ চালাতে বাধ্য হয়েই তাকে পড়াশুনা ছাড়তে হলো। একে একে রাশেদের অনুভূতির সমস্ত আকাশ অনায়াসেই ফিকে হতে শুরু করলো। ফিকে হতে লাগলো তার ভালোবাসার মানুষটির হাসি ভরা মুখখানি। হ্যাঁ, নিশিতার সাথে কখন যে সম্পর্কের মায়ায় জড়িয়ে গেছে তা দু’জনের কেউই আজ মনে করতে পারে না। শুধু দুজনেই বুঝতে পারে একে অপরকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। একদিকে বাবার অসুস্থতা; অন্যদিকে মা ও ছোটভাই—বোনের সকরুণ চেয়ে থাকা। তার উপর নিশিতার ভালোবাসার দাবী। সবাই—ই যেন তার কাছে চাহিদা প্রত্যাশী। অথচ অভাব পূরণকারী এই উঠতি যুবক আজ পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষের একজন। কয়েকটা ছোটখাটো টিউশনি করে যা কিছু পায় তাতে বাবার ওষুধ আনার পরে যা অবশিষ্ট তা দিয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটে।
উপায়হীন রাশেদের মনে পড়েÑতখন সে ক্লাস ‘সিক্স’—এ আর নিশিতা ‘ফাইভে’। কোনো এক ক্লান্ত বিকেল। সবে স্কুল ছুটি হয়েছে। স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য স্তূপাকারে ইট জড়ো করা হয়েছে। রাশেদ—নিশিতা সেখান থেকে কিছু ইটকে নির্দিষ্ট দুরত্বে খাড়া করে দাঁড় করিয়ে একটাকে ধাক্কা দিতেই পরপর সাজানো ইটের একটার গায়ে অন্যটি ধাক্কা খেয়ে খেয়ে সারিবদ্ধভাবে গায়ে গা মিশিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। খেলাটিকে সেদিন অসম্ভব উপভোগ্য মনে হচ্ছিলো। বারবার তারা এই একই খেলা খেলছিলো। কাত হয়ে পড়ে যাওয়া ইটগুলোকে দেখতে বেশ পরিপাটি মনে হলেও কেন যেন মনে হচ্ছিল পড়ে যাওয়া ইটগুলোর নিজেদের আর উঠে দাঁড়ানোর কোনো উপায় থাকে না। কোনো এক অসাবধান মুহূর্তে সেদিনে ইটের ধাক্কা লেগে নিশিতার হাতের আঙ্গুল থেঁতলে গিয়েছিলো। খুব কেঁদেছিল। ভুল করে হলে আঘাত লেগে থেঁতলে গিয়েছে এজন্য বেশ অনুশোচনা হচ্ছিলো রাশেদের। তাই তো মনের অলক্ষ্যে কাছে টেনে সেদিন নিজ হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়েছিল। সান্ত্বনা দিয়েছিল। নিশিতার আব্বা আম্মা কিভাবে এমনটি হলো জানতে চাইলে নিশিতা সেদিন কিছুতেই রাশেদের কথা বলে নাই। বরং বিশ্বাস যোগ্য নয়; অথচ, সাজানো কথা বলেছিল‘পড়ে গিয়ে থেঁতলে গিয়েছে’। সেই থেকে কেন যেন দু’জন দু’জনের উপর অন্যরকম এক টান কাজ করতো। দুজনকে দুজন খুব বিশ্বাস করতো।
আজ রাশেদের কেন যেন মনে হচ্ছে নিশিতাকে ডেকে এনে তাকে তার এই ব্যর্থ জীবন থেকে মুক্ত করে দেয়া—ই ভালো। আর সেটাই হবে ভালোবাসার সার্থক পুরস্কার। এমন বিষাক্ত জীবনের সাথে তাকে জড়িয়ে রেখে আর কি লাভ? ছোটোবোন রোখসানা’র মাধ্যমে তাকে ডেকে আনে। রাশেদ সেই পুরানো পড়ার ঘরে চেয়ারে বসে উল্টোদিকে মুখ করে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটি পড়ছিল। পিছন থেকে ঢুকে চিরাচরিত উচ্ছ্বলতা নিয়ে রাশেদের চোখ ধরে নিশিতা। অন্যদিনের মতো রাশেদ আনন্দের হাসি না হেসে হাত দুটি ছাড়িয়ে দিয়ে গুরু—গম্ভীর গলায় বলে-
বসো।
তুমি অমন নিরসভাবে বলছো কেন? একটু ভালো করে বলো। কেন কাকার শরীর কি আরো খারাপ হয়েছে?
নাহ্। তা নয়।
তবে কি হয়েছে বলো তো। তোমার এমনভাবে থাকাটা আমার কিছুতেই পছন্দ নয়। এমন ভাব করলে আমি কিন্তু কান্না শুরু করে দেবো। একটু হাসো, হাসো না তুমি? প্লিজ…। কি হয়েছে তোমার?
সত্যিইতো নিশিতা সেই ছোটকাল থেকে কোনোদিনও এমন রূপে রাশেদকে দেখে নি। রাশেদ তাই বাধ্য হয়ে কৃত্রিম হাসি হাসার চেষ্টা করে বললোÑ
বলছি তো কিছু হয় নি। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে তোমাকে কিছু কথা আজ না বললেই নয়। আশা করি তুমি আবেগ দিয়ে নয়; সম্পূর্ণই বিবেক দিয়ে ভাববে।
আমার ভয় হচ্ছে গো। তুমি কি এমন বলবে যেটা আমাকে এমন করে বলছো? তোমার জীবনের কি এমন আছে যা আমার নিকট গুরুত্বহীন। আচ্ছা, বলো, তবে শুনি…
আচ্ছা, তোমার কি স্কুলের সেই ইট সাজিয়ে খেলার কথাটা মনে আছে? যেদিন আমাদের প্রথম…
হ্যাঁ, সেকি আর ভোলার। আমার আঙ্গুলটা থেঁতলে গিয়েছিল। এখনো সে কথা ভাবি আর একা একা হেসে উঠি। আব্বা আম্মা কতবার জিজ্ঞেস করেছিল। কিভাবে হলো? আমি বলছিলাম পড়ে গিয়েছি, তাই…। কিছুতেই তারা বিশ্বাস করছিল না। আর আমিও সত্যিটা স্বীকার করছিলাম না। কেন? তা নিয়ে আবার কি হলো?
না মানে; খেলাটা কেমন ভয়ঙ্কর সুন্দর ছিল ভেবে দেখেছো?
সে কেমন?
মানে সমস্ত ইটগুলো নির্দিষ্ট দূরত্বে কি সাবলীল দাঁড়িয়েছিল। অথচ প্রথম ইটখানা পড়লো তো এক এক করে ধাক্কা খেতে খেতে পরপর সকল ইট পড়ে গেল!
হ্যাঁ, তাইতো। আজও বাচ্চাদের এ খেলা খেলতে দেখলে সেই হারানো দিনে ফিরে যাই। মনে হয় সেই দিনগুলি আবার যদি ফিরে পেতাম…
আর আমি ভাবি সেদিন কেন ওই খেলা খেলেছিলাম?
কেন? তোমার কি অতীতকে মনে করতে ভালো লাগে না? আমি কিন্তু ভেবে ভেবে সুখ পাই। ওই খেলা না খেললে আমার হাতও থেঁতলে যেত না। আর তোমার আদরও পাওয়া হতো না। তা, ওভাবে ভাবো কেন বলে তো?
না মানে… আমার জীবনটাকে আজ মনে হচ্ছে ওইদিনের ওই খেলারই মতো।
কেন? কিভাবে?
আমার বাবাকে আজ মনে হচ্ছে ওই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রথম ইটখানা। আর আমরা সকলে যেন ওই পরবর্তী ইটের সারি। হ্যাঁ, ওই খেলায় প্রথম ইট পড়ে গেলেই একে একে দলবেঁধে সব ইট পড়ে যেত। আমাদেরও এখন দাঁড়িয়ে থাকার কোনো উপায় নেই আর। সেদিনে আমরা যেমন খুব মজা পেতাম। আজ মনে হচ্ছেÑবিধাতা আমাদের নিয়ে ওই নিঠুর খেলায় মেতেছে। খুব মজা পাচ্ছেন। তাই বলতে চাচ্ছিলাম কি…
রাশেদের কন্ঠ জড়িয়ে যায়। চোখের কোণে জল আসে। নিশিতাও কোনো কথা খুঁজে পায় না। নিঃশব্দে রাশেদের কাঁধে হাত রাখতে চায়। (চলবে)
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | |
৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ |
১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ |
২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ |
২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |