যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, সর্বশেষ উদ্ভাবন, চিকিৎসাসেবা, ওষুধ-পথ্য থেকে শুরু করে সুখের যাবতীয় উপকরণ কিনে নেন। ভোগ করেন। আর যাদের টাকা নেই, তারা কেবল বঞ্চিত হন, দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। করোনার টিকা নিয়েও দুনিয়ায় একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ধনী দেশগুলো বেশির ভাগ টিকা আগাম টাকা দিয়ে কিনে কুক্ষিগত করেছে। পক্ষান্তরে গরিব দেশগুলো এখন টাকা দিয়েও টিকা পাচ্ছে না। টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ধনী দেশের টিকা সরবরাহ করতেই ব্যস্ত। তাদের চাহিদা পূরণ হলেই শুধু অন্যদের কথা বিবেচনার সুযোগ আসবে।
এমন পরিস্থিতি যে সৃষ্টি হবে তা আগেভাগেই অনুমান করা হয়েছিল। গত বছর যখন টিকা তৈরির প্রবল উদ্যোগ চলছিল সে সময় বিশ্বখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় ‘দ্য আনইকুয়াল স্ক্রামবেল ফর করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, ‘ধনী দেশগুলো টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর সঙ্গে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডোজের চুক্তি করে ফেলেছে। এর ফলে পৃথিবীর মাঝারি এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ভ্যাকসিনের সরবরাহ সীমিত হয়ে পড়বে।’ এই অনুমান এখন সত্যে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশকে বঞ্চিত করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীনে উৎপাদিত টিকা ইতিমধ্যেই ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়েছে।
উচ্চ-আয়ের দেশগুলোর কাছে বর্তমানে ৪৬০ কোটি ডোজ টিকা রয়েছে, নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোর কাছে আছে মাত্র ৬৭ কোটি ডোজ টিকা। এখন পর্যন্ত উৎপাদিত টিকার বেশির ভাগ অংশ কিনে নিয়েছে মাত্র ১০টি ধনী দেশ। এই ১০টি ধনী দেশের জিডিপি পৃথিবীর মোট জিডিপির ৬০ শতাংশ এবং দেশগুলোর জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৬ শতাংশ। এখন পর্যন্ত টিকাকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে যুক্তরাজ্য। সেখানে ৮৭ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। আমেরিকায় ৮৩ শতাংশ, জার্মানি ও কানাডায় ৫২ শতাংশ, স্পেনে ৫০ শতাংশ এবং ফ্রান্সে ৪৫ শতাংশ টিকাকরণ সম্পন্ন হয়েছে। পক্ষান্তরে ২৫০ কোটি জনসংখ্যার ১৩০টি দেশে একটিও টিকার ডোজ দেওয়া হয়নি। যদিও তারা করোনার সংকটে খুব খারাপ সময় পাড়ি দিচ্ছে।
টিকা নিয়ে বড় দেশগুলো রাজনীতি শুরু করেছে। টিকার মালিক দেশগুলো নিজস্ব বলয়ের দেশে প্রথমে টিকা দিতে চাইছে। টিকা রাজনীতির একদিকে আছে মুনাফার হাতছানি, আরেকদিকে বাজার দখল করে বাকিদের নির্ভরশীল করার রাজনীতি। স্বল্পমূল্যে টিকা দিয়ে বড় বড় বাণিজ্যিক চুক্তি হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দাও আছে টিকার মালিক দেশগুলোর। চীন এ বিষয়ে সম্প্রতি বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছে। যেসব দেশে চীনের বিনিয়োগ আছে, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার সুবিধা দিতে একটা জোটও গঠন করেছে তারা। এই টিকা-রাজনীতির মধ্যেও বিশ্বের ধনী দেশগুলোর কাছে আগেই পৌঁছে যাচ্ছে টিকার ডোজ। সেই তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে নিম্নবিত্ত দেশগুলো।
কানাডা ৩৩ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা অর্ডার করেছে, যা দেশটির সব মানুষকে পাঁচবার টিকা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। যুক্তরাজ্য ৪৫ কোটি ৭০ লাখ টিকার বন্দোবস্ত করেছে, যা দিয়ে দেশটির সব নাগরিককে তিনবারের বেশি টিকা দেওয়া যাবে। ১৮০ কোটি ডোজ কিনে রেখেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যা দিয়ে জোটভুক্ত দেশগুলোর জনগণকে দুবারের বেশি টিকা দেওয়া যাবে। অস্ট্রেলিয়া কিনে রেখেছে ১২ কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা, যা দিয়ে দেশের নাগরিকদের আড়াইবার টিকা দেওয়া যাবে। ১২০ কোটি ডোজ টিকার ব্যবস্থা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা দিয়ে দেশটির জনগণকে দুবার টিকা দেওয়া যাবে। ফলে নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত দেশগুলো চাহিদামতো টিকা পাচ্ছে না।
বিশ্ব এখন চরম টিকাবৈষম্যের মুখোমুখি। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব টেড্রোস অ্যাডহ্যানোম গ্যাব্রিয়েসাসও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানিয়েছেন, ‘এ যাবৎ ১২৪টি দেশে ৬.৩ কোটি টিকার ডোজ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে তা এই দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যার মাত্র ০.৫ শতাংশ! এমনকি, এ মুহূর্তে বহু উচ্চবিত্ত দেশ শিশু ও নাবালকদের টিকাকরণের পথে যাচ্ছে। অথচ এখনো বিশ্বের বহু স্বাস্থ্যকর্মী, বৃদ্ধ ও অন্য ঝুঁকিবহুলদের ক্ষেত্রে টিকাকরণ হয়নি।’
এদিকে ভারতে করোনার ব্যাপক সংক্রমণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বৈশ্বিক টিকা বিতরণের উদ্যোগ কোভ্যাক্স। বিশ্বের নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেও করোনার টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটির (কোভ্যাক্স) উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ছাড়াও স্বল্পমূল্যে টিকা দেওয়ার জন্য বৈশ্বিক উদ্যোগ ‘গ্যাভি’ এবং সংক্রামক রোগের টিকা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক সংস্থা ‘সিইপিআই’ এই রয়েছে উদ্যোগে। এ বছর ২০০ কোটি টিকা সংগ্রহ করে বিতরণের লক্ষ্য ছিল কোভ্যাক্সের। এর অর্ধেক টিকা পাওয়ার কথা ছিল সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে। কিন্তু ভারত সরকার গত মার্চে টিকা রপ্তানি স্থগিত করার পর সেরাম থেকে আর কোনো চালান পায়নি কোভ্যাক্স।
এই পরিস্থিতিতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রতি কোভ্যাক্সে টিকা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেছেন, জি-সেভেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো গত তিন মাসে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে, তা থেকে মাত্র ২০ ভাগ দান করলেই ভ্যাকসিনের অভাবে সংকটের মুখোমুখি অনুন্নত দেশগুলো ১৫ কোটি ৩০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাবে। এতে দেশগুলো সংকট অনেকটা সামাল দিতে পারবে।
ভারতের পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও বিপদের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষকে দেওয়া হচ্ছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকা। কোভিশিল্ড বাংলাদেশে দেওয়ার জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বেক্সিমকোর মাধ্যমে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ সরকার। ছয় মাসের মধ্যে তিন কোটি টিকা আনার চুক্তি হয়েছিল। গত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত থেকে দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশ পেয়েছে। এ ছাড়া ভারত সরকারের উপহার হিসেবে দিয়েছিল ৩২ লাখ ডোজ।
সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও গত তিন মাসে কোনো চালান আসেনি। সম্প্রতি ভারতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সংকটজনক হওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে দেশটি থেকে টিকা আসার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে টিকাকরণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এখানে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া এবং নিবন্ধন কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়েছে। এখন শুধু দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে চীন থেকে উপহার হিসেবে পাঠানো সিনোফার্মের ৫ লাখ ডোজ টিকা ঢাকায় পৌঁছেছে ১২ মে। আরও ৬ লাখ টিকা উপহার হিসেবে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও এক থেকে দুই কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা চাওয়া হয়েছে। রাশিয়া থেকে টিকা আনার ব্যাপারেও চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু এসব দেন-দরবারের কতটুকু ফলপ্রসূ হয়, সে আশঙ্কা থাকছেই।
আসলে এখন পৃথিবীতে একটি নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদ জন্ম নিচ্ছে ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’। যেখানে ধনী দেশেরা লাভবান হচ্ছে। কিন্তু যদি পৃথিবীর সব দেশে টিকাকরণ প্রক্রিয়া ঠিকমতো না হয় তাহলে এই মহামারী আরও অনেক বছর প্রলম্বিত হতে পারে। বিশ্বনেতৃত্বের এখন সময় এসেছে টিকা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্যের জগতে সবার সম্পত্তি
হিসেবে বিবেচনা করার, যা অবশ্যই সবার কাছে সুলভ হবে এবং সবার কাছে পৌঁছাবে। যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা ‘ক্রিটিক্যাল মাস’-এর কাছে টিকা পৌঁছানোর এই কাজটি সফলভাবে করা যায় তাহলে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের শরীরে কৃত্রিমভাবে ইমিউনিটি তৈরি করা যাবে, যেমনটা স্মল পক্স বা পোলিওর ক্ষেত্রে হয়েছে। এর পরিণতিতে এই রোগটির বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি বা গোষ্ঠী অনাক্রমণ্যতা গড়ে উঠবে এবং রোগটি আপাতত নিস্তেজ অবস্থায় চলে যাবে (যদিও এর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরা আবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে কখন পরিস্থিতি বুঝে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধা যায়)।
এ কথা ঠিক যে, করোনার টিকা সবার জন্য সহজলভ্য করার কাজটি রাতারাতি হবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যাদের সামর্থ্য আছে তারাই শুধু এই টিকা পাবে। এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে মনে রাখতে হবে যে, যেসব জায়গায় এই টিকা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেখানে যদি এটা না দেওয়া যায়, তাহলে এই মহামারী চলতেই থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত তারাও নিরাপদ থাকবে না।
লেখক লেখক ও কলামনিস্ট
chiros234@gmail.com
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | |
৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ |
১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ |
২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ |
২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |