লক্ষণ মানে রোগ নয়, লক্ষণ দেখে রোগ বোঝা যায়। যেমন ঢাকায় কিছু নতুন ভিক্ষুক দেখা যাচ্ছে। ব্যস্ত রাস্তার পাশে হঠাৎ কোনো নারী বলে উঠছেন, ভাই একটু শুনবেন, কিছু সাহায্য চাইতেছি! কণ্ঠ শুনেই মনে হবে নতুন ভিক্ষুক। এখনো চাওয়ার কায়দাটা ভালো করে রপ্ত করে উঠতে পারেনি। পল্টন, তোপখানা, সেগুনবাগিচায় এ ধরনের অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগতভাবে অনেকেরই হয়েছে। দেখেশুনে একবার মনে হয় পেশাদার ভিক্ষুকের নতুন ভোলপাল্টানো নয় তো! ঢাকায় কত যে প্রতারণার পথ ও পদ্ধতি আছে! সালাম পার্টি, মলম পার্টি, থুতু পার্টি, ধাক্কা পার্টি এসবের কারণে কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু কথা শুনে এবং জড়সড় লজ্জিত ভঙ্গি দেখে এসব ভিক্ষুককে এতটা সন্দেহ করতে ইচ্ছা হয় না। আবার প্রায় সবারই এটা চোখে পড়ছে যে, লকডাউনের মধ্যে ভিক্ষুকের সংখ্যা একটু বেড়েছে। প্রচণ্ড রোদ, রোজা আর কঠোর লকডাউনের শিথিল প্রয়োগের মধ্যে ভিক্ষুকের সংখ্যা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এলাকায় আগের তুলনায় বেশি চোখে পড়ছে। রিকশাচালকদের মধ্যেও কিছু চালক পাওয়া যাচ্ছে। তাদের কোথাও যেতে চাইলে বলছে, যা ন্যায্য ভাড়া তাই দিয়েন, একটু চিনায়া নিয়েন স্যার। এই লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা এবং অসহায়ত্ব বাড়ছে।
মানুষ ব্যক্তিগতভাবে যা দেখে তা সে সব সময় জোর দিয়ে বলতে চায়। কিন্তু ব্যক্তিগত দেখা পুরো সত্যকে প্রতিফলিত করে না। সে কারণে সাধারণ জরিপ প্রয়োজন হয়। অনেকের দেখার সঙ্গে নিজের দেখাটাকে সমন্বিত করে নেওয়া সম্ভব হয় তাতে। সম্প্রতি কভিড-১৯-এর ফলে আয় এবং কর্মসংস্থান, মানুষ কীভাবে টিকে আছে এ বিষয় নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং অক্সফাম। তাদের জরিপে উঠে এসেছে কিছু বিষয়, যার ফলে কভিডের কারণে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিটা বুঝতে সহজ হবে। আত্মতৃপ্তির পরিবর্তে সত্যানুসন্ধান করা এবং সমাধানের পথ খোঁজা দায়িত্বশীল মানুষের কাজ। জরিপের তথ্যগুলোকে বিবেচনায় নিলে যথাযথভাবে দায়িত্বপালনের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। সামনে আসছে নতুন বাজেট। বাজেটে অর্থ সংস্থান এবং ব্যয় বরাদ্দ কোথায় বাড়াতে বা কোথায় কমাতে হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে এই জরিপ সহায়তা করবে বলে মনে হয়।
করোনার প্রথম ধাক্কা কাঁপিয়ে দিয়েছে সারা পৃথিবীকে, আর দ্বিতীয় ধাক্কা আতঙ্ক বাড়িয়েছে। মানুষ প্রধানত ভেবেছে জীবন নিয়ে। কীভাবে বাঁচবে সে? কিন্তু যেহেতু অর্থনীতি হচ্ছে ভিত্তি তাই যেকোনো সমস্যার মূলে থাকে অর্থনৈতিক সমস্যা। করোনায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জীবিকা বা অর্থনৈতিক সমস্যা তাড়া করে ফিরছে মানুষকে। শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা অনেক তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। সিপিডি আর অক্সফামের গবেষণা দেখাচ্ছে যে, করোনার প্রথম ধাক্কায় ৬২ শতাংশ শ্রমজীবী কাজ হারিয়েছেন। নতুন করে কাজ খুঁজেছেন তারা। এক মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত বেকার ছিলেন অনেকেই। যারা কাজ পেয়েছেন, তাদের আবার আয় কমেছে। আয় না থাকলে বা কমে গেলে মানুষ যা করে তাই করেছে এরা। ফলে জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৫২ শতাংশ মানুষের খাদ্য গ্রহণ কমেছে। এটা তো জানা কথাই যে খাবারের সংকট হলে সবচেয়ে কষ্টে থাকে নারীরা, উপেক্ষিত হয় বৃদ্ধরা এবং পুষ্টিবঞ্চিত হয় শিশুরা। ৫০ শতাংশ মানুষের সঞ্চয় কমেছে। জাতীয়ভাবে মাথাপিছু আয় বাড়লেও শ্রমজীবীদের মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে। প্রচার যাই থাক না কেন, পরিমাণ যাই হোক না কেন, সরকারি সহায়তা ছিল অপ্রতুল। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ সহায়তা পেয়েছে। করোনাকালে সাহায্য সহায়তার জন্য মানুষ ছুটেছে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কাছে। কিন্তু এই মহামারীর মহা-আতঙ্কের সময় কে আর কাকে সাহায্য করে! কতটুকুইবা পারে! এ তো গেল শ্রমজীবীদের কথা। নিম্নমধ্যবিত্তদের চাপা কান্না তো আরও বেদনার।
ভরসা বা দাবি তখন সরকারের কাছে। আইএমএফের তথ্যে দেখা যায়, করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় জিডিপি অনুপাতে সবচেয়ে কম সরকারি ব্যয়ের দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশ একেবারে পেছনে। ধনী দেশগুলো যেমনÑ যুক্তরাষ্ট্র ২৫.৫, যুক্তরাজ্য ১৬.২, জাপান ১৫.৯, জার্মানি ১১ শতাংশ বরাদ্দ করেছিল। এরপর থাইল্যান্ড ৮.২ শতাংশ এবং চীন ৪.৮ ও মালয়েশিয়া ৪.৫ শতাংশ বরাদ্দের কথা বাদ দিলেও যখন দেখা যায় কম্বোডিয়া ৪.১ শতাংশ, ভারত ৩.৩, কেনিয়া ২.৪, আফগানিস্তান ২.২ এবং পাকিস্তান ২.০ শতাংশ বরাদ্দ করেছিল, সে তুলনায় বাংলাদেশের বরাদ্দ ছিল ১.৪ শতাংশ। কভিড-১৯-এ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৩টি প্যাকেজের মাধ্যমে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ঋণ, নগদ অর্থ আর খাদ্য সহায়তার ঘোষণা করেছিল সরকার। এর মধ্যে ৯০ হাজার কোটি টাকাই ছিল ব্যাংকঋণ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ঘোষিত প্যাকেজের আওতায় ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ৫৯.৪৫ শতাংশ টাকা। এমনকি করোনার জন্য স্বাস্থ্য খাতে যে থোক বরাদ্দ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছিল তার মাত্র ২৫০০ কোটি টাকাও খরচ করা হয়নি। অথচ হাই ফ্লো অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের কি হাহাকারই না দেশবাসী দেখল করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়।
গার্মেন্টস শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখ দাবি করে তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার জন্য গার্মেন্টস মালিকরা ২% সুদে সহজশর্তে প্রথমে ৫ হাজার কোটি টাকা, পরে আরও আড়াই হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা হিসেবে পেয়েছেন। বড় শিল্পের মালিকরা প্রণোদনা পেয়েছেন ৩০ হাজার কোটি টাকা, মাঝারিশিল্পের মালিকরা পেয়েছেন ২০ হাজার কোটি টাকা, কৃষি ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরাও পেয়েছেন ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের অর্থ বিভাগের এক রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, করোনাকালে শ্রমিক ও দরিদ্রদের জন্য যা বরাদ্দ হয়েছিল তা পুরোপুরি বিতরণ করা হয়নি। যেমন :
ক. কর্মহীন দরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ ২৫০০ কোটি টাকা অথচ বিতরণ হয়েছে ১০৬৮ কোটি টাকা।
খ. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো। বরাদ্দ ৮১৫ কোটি টাকা, বিতরণ ২৩ কোটি টাকা।
গ. গৃহহীন মানুষের জন্য ঘর নির্মাণ বরাদ্দ ২১৩০ কোটি টাকা আর বিতরণ ১৪৭৪ কোটি টাকা।
ঘ. দরিদ্র বয়স্ক এবং বিধবা নারীর ভাতা ১২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ আর বিতরণ ২৬২ কোটি টাকা।
ঙ. ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ আড়াই হাজার টাকা প্রদান-বরাদ্দ ১২৫৮ কোটি, বিতরণ হয়েছে ৮৮০ কোটি টাকা।
চ. কর্মহীন শ্রমিকদের নগদ সহায়তা বরাদ্দ ১৫০০ কোটি টাকা অথচ বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা।
ছ. ১০ টাকা কেজির চাল বিতরণের জন্য বরাদ্দ ৭৭০ কোটি টাকা, এই একটি ক্ষেত্রে বরাদ্দের টাকার শতভাগ ব্যবহৃত হয়েছে।
অর্থাৎ, করোনার প্রথম প্রবাহের সময় যে অর্থ শ্রমিক কিংবা দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল তার অর্ধেকও বিতরণ করা হয়নি। সরকার বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে। দেশের স্বার্থে এটা জরুরি। কিন্তু ৫০ লাখ পরিবহন শ্রমিক, ৪০ লাখ নির্মাণ শ্রমিক, ৩৫ লাখ রিকশা, ব্যাটারি রিকশা, ইজিবাইক চালক, ২০ লাখ দোকান-হোটেল শ্রমিক, বেকারি শ্রমিক, ৫ লাখ বিউটি পার্লার, সেলুন কর্মচারী, ৫ লাখ পর্যটনসংশ্লিষ্ট শ্রমিকসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা তো সরকারি কর্মচারী নন যে বেতনটা ঠিকমতো পাবেন। কাজ বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের বাড়ির চুলা জ্বলে না, সেই কথাটা তো ভাবা দরকার ছিল। আমরা একটা হিসাব করে দেখিয়েছিলাম, বিজ্ঞানসম্মতভাবে ১৫ দিন লকডাউনে চলাকালীন অন্তত ১৫ কেজি চাল, ৩ কেজি ডাল, ২ লিটার তেল আর নগদ ৫০০ টাকা করে দিলে প্রতি শ্রমিকের জন্য খরচ হতো ২৫০০ টাকা। শ্রমিকরা ভাবত যে সরকার তাদের পাশে আছে। কত খরচ হতো এতে? কাজ হারানো ২ কোটি শ্রমিকের জন্য ৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেই শ্রমিকদের ন্যূনতম সহায়তা করা সম্ভব হতো। নতুন বাজেট আসছে, পুরনো বাজেটের অনেক খাতের টাকা খরচ হয়নি, করোনার জন্য বরাদ্দ টাকা পুরোপুরি বিতরণ হয়নি, অতএব টাকার তো অভাব নেই। উৎপাদনের চালিকাশক্তি বলে আদর করে যাদের ডাকা হয় সেই শ্রমিকদের প্রতি মনোযোগের অভাব উৎকট রূপে দেখা গেল করোনাকালেও।
কোটি শ্রমজীবীর এই দুর্দশাকালেও কিন্তু থেমে থাকেনি কোটিপতি তৈরি এবং তাদের আয় বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে দেখা যায় এপ্রিল ২০২০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০ এই ৬ মাসে ১ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা বা তারও বেশি আমানত আছে এমন কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৪৮৬৫টি। এর মধ্যে ৫০ কোটি ও তার চেয়ে বেশি টাকা আছে এমন আমানতকারীর সংখ্যা ৬ মাসে বেড়েছে ৬৯টি। বাংলাদেশের টাকাওয়ালাদের টাকা যেসব ব্যাংকের মাধ্যমেই লেনদেন হয় তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। মাটি ফুঁড়ে এবং ছাদ ফেটে যাদের টাকা আসে তাদের টাকা বাতাসে উড়ে। ফলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কোটিপতি বৃদ্ধির এই সংখ্যা আরও বেশি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। ১৯৭২ সালে ৫ জন কোটিপতি নিয়ে যে দেশের যাত্রা শুরু সে দেশ এখন বিশ্বে দ্রুত গতিতে ধনী হওয়া দেশের মধ্যে প্রথম। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষে থামেনি তাদের গতি, কমেনি তাদের সংখ্যা বরং বেড়েছে দ্রুত। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কোটিপতি এবং দরিদ্র দুটোই বেড়েছে করোনার প্রথম ধাক্কায়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে দ্বিতীয় ধাক্কায় শ্রমজীবীদের সংখ্যা ও দুর্দশা আরও বাড়বে।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | |
৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ |
১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ |
২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ |
২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |