মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের প্রস্তাব এসেছে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইনের সংশোধিত খসড়ায় এসব নেতাদের পরিচয় ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৯৭২ সালে গণপরিষদ গঠিত হলে নির্বাচিত এই নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে নতুন আইনের খসড়ায় তাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করে তাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে নতুন পরিচয় দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ৯৪তম সভায় এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সংশ্লিষ্ট খসড়ায় স্বাক্ষর করেন। সংশোধনীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি চার শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী পেশাজীবীরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন এবং বিশ্বজনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন।মুজিবনগর সরকারের অধীনে কর্মকর্তা, কর্মচারী, দূত ও অন্যান্য সহযোগীরা।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, কলাকুশলী ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংবাদিকরা।স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা। এটি কার্যকর হলে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তত ১০ হাজার ব্যক্তি তাদের পরিচয় বদলাবে এবং তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হবেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, "বীর মুক্তিযোদ্ধা কেবল তারাই থাকবেন, যারা অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। রাজনীতিবিদরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, তাই তাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে।"
তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, "আইন বদলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান পরিবর্তন করা যায় না। এটি অপ্রয়োজনীয় এবং অপচয়মূলক উদ্যোগ।" মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালও বলেছেন, "মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, কেবল সামরিক যুদ্ধ নয়। রাজনীতিবিদদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাই তাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করা উচিত নয়।"
এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, তারাই বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।
এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় থাকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিৎসক এবং নার্সদের মুক্তিযোদ্ধার পরিবর্তে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই খসড়া আইনের প্রস্তাবিত অনুমোদনের পর, যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও মর্যাদা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নানা দিক নিয়ে আলোচনা উত্থাপন করবে।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?