একদিন পরেই পহেলা বৈশাখ। কথায় বলে বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর পার্বণ মানেই তো উৎসবের উৎস। উৎসব মানেই ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে’। চারদিকের কঠিন বাস্তবতায় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাধারণ জনগণ আনন্দ খুঁজে নেয়। রবীন্দ্রনাথ উৎসবের সংজ্ঞায়নে বলেছেন, ‘উৎসবের দিনে আমরা যে সত্যের নামে বহুতর লোকে সম্মিলিত হই, তাহা আনন্দ, তাহা প্রেম। উৎসবে পরস্পরকে পরস্পরের কোনো প্রয়োজন নাই, সকল প্রয়োজনের অধিক যাহা, উৎসব তাহাই লইয়া। এজন্য উৎসবের একটা প্রধান লক্ষণ প্রাচুর্য। উৎসব দিনে আমরা প্রতিদিন এর কার্পণ্য পরিহার করি, প্রতিদিন যেমন হিসাব করিয়া চলি, আজ তাহা অকাতরে জলাঞ্জলি দিতে হয়। উৎসবের দিন দৈন্যের দিন নয়, আজ ঐশ্বর্যের দিন।’
মানুষ নিজের নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মধ্যে ক্ষুদ্র হয়, কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে একত্রে মিলিত হয়ে বৃহৎ হয়। যে কোনো ছোট-বড় উৎসবের দিনে মানুষ যেহেতু সমস্ত ক্ষুদ্রতা, হীনতা, অসততার গণ্ডিকে অতিক্রম করে নিতে পারে; তাই সেই বিশেষ দিনকে আনন্দের দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। উৎসবে সবসময় একটি শুভবোধ থাকে। একটা মঙ্গলজনক ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ। একটি সৎ উদ্দেশ্যে ঘিরেই উৎসবের আয়োজন হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেন, ‘সত্যকে অস্বীকার করিয়া ভন্ডামি দিয়া কখনো মঙ্গল উৎসবের কল্যাণ প্রদীপ জ্বলিবে না।’ তাই তো যে কোনো ধরনের কল্যাণমূলক আনন্দময় অনুষ্ঠানকেই উৎসব বলে। উৎসব মানুষের মনের সব দুশ্চিন্তা, হতাশা দূর করে প্রাণবন্ত করে তোলে। উৎসব এলে ধনী-গরিব, দুঃখী-সুখী, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবার মধ্যে একতাবোধ ও সাম্যের আনন্দ দেখা দেয়। বাংলাদেশের মানুষ আর্থিক, পারিপার্শ্বিক বা পরিবেশগত টানাপোড়েনের ভেতর থাকলেও যে কোনো উৎসবকে সাদরে নিয়ে উৎসবে মেতে থাকতে পছন্দ করে। বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে ঈশ্বরগুপ্ত খাঁটি কথাটিই বলেছেন, ‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা’।
বাঙালি জাতির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যই হলো হৈ-হুল্লোড় করা। তারা আড্ডাপ্রিয় এবং ভোজনরসিকও বটে। তাই যে কোনো উৎসবে এসব গুণের প্রকাশ পায়। বাংলাদেশে নানা ধরনের উৎসব দেখা যায়, যেমন—ধর্মীয়, সামাজিক, জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক। ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ঈদুল ফিতর, দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, কোরবানির ঈদ, বুদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন, বৈসাবী পূজা উৎসব হিসেবে উল্লেখযোগ্য প্রাধান্য পায়। সামাজিক উৎসবের মাধ্যমে মানুষ আনন্দ খুঁজে নেয়। এ বছর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কর্তৃক আয়োজিত ঈদউৎসব পালনে ঈদ শোভাযাত্রা সবার মাঝে আলাদা আনন্দের উৎস হিসেবে যোগ হয়েছে। জাতীয় দিবসসমূহে জাতীয় উৎসব পালনেও বাংলাদেশের মানুষ আনন্দ করে থাকে। যেমন—২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উৎসব হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। ইদানীং কয়েক বছর থেকে বাঙালি জাতির নববর্ষ উদযাপন তথা ‘পহেলা বৈশাখ’ সরকারিভাবে পালন করা হয়ে থাকে। জাতীয় দিবসসমূহের মতো পয়লা বৈশাখ এখন সাড়ম্বরে পালিত হয়।
পহেলা বৈশাখের এ উৎসব পরিণত হয়েছে সব থেকে বড় উৎসবে। কারণ এই একটি মাত্র উৎসবে ধর্ম-বর্ণ-ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ একসঙ্গে একই অনুভবে একাত্ম হয়ে উৎসবে শামিল হন। উদযাপন করেন বাংলাদেশের তথা বাংলার গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। বছরের প্রথম দিনটিকে আনন্দঘন উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করার রীতি-রেওয়াজ বহু প্রাচীন, পৃথিবীর বহু দেশে প্রচলিত আছে। আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখের উৎসব মূলত সাংস্কৃতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় জমজমাট আয়োজন নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে থাকে। যত দিন যায়, বছর ঘুরে আসে, নতুন বছর নতুনভাবে আলাদা আনন্দমুখর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের ডিসি হিল, শিরিষ তলা, আমবাগান আরও নানা স্থান পহেলা বৈশাখের ভোর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন সাঁই, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিমের গান এবং গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে সুরে সুরে আকাশ ভরিয়ে তোলেন। এসব গানে থাকে পুরোনো বর্ষের ব্যর্থতা গ্লানি পরিত্যাগ করে নতুন বছরের নতুন সম্ভাবনায় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা। প্রায় সবখানে বেশি শোনা যায় রবীন্দ্রনথের—‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’।
গ্রামের চেয়ে শহরে পহেলা বৈশাখ উদযাপন বেশ আনন্দঘন পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিছু কিছু গ্রামে পহেলা বৈশাখের আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চড়কপূজা বা ক্ষেত্রপাল পূজা করে থাকে। এ উপলক্ষে মেলা বসে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে নানা স্থানে বৈশাখী মেলা বসে। মেলায় ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান, যা বাংলার ঘরে ঘরে নিত্য ব্যবহার্য। এসব সামগ্রীর প্রচুর পসরা সাজিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা বৈশাখী মেলাকে অন্যান্য মেলা থেকে আলাদা মাত্রা এনে দেয়। গ্রামে বা শহরে মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলার প্রতিটি ঘরে এই বৈশাখী মেলা থেকে কিছু না কিছু কিনে থাকে। এই উৎসবকে ঘিরে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ঘরে ঘরে সাজ সাজ রব ওঠে। উৎসবের সঙ্গে আনন্দের যোগ আছে। তাই আনন্দকে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য, পুরোনো বছরে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে সাধ্যমতো নতুন কাপড়, নতুন আসবাবপত্রেরও আগমন ঘটে কোনো কোনো ঘরে। কেউ কেউ ঘরদোর ফুল-পাতার মালা দিয়ে সাজিয়ে তোলে। এই সাজসাজ রবের সমর্থন পাই রবীন্দ্রনাথের কথায়। তিনি বলেছেন, ‘উৎসব এর দিন সৌন্দর্য এর দিন। এই দিনকে আমরা ফুল পাতা দ্বারা সাজাই, দীপমালার দ্বারা উজ্জ্বল করি, সংগীতের দ্বারা মধুর করিয়া তুলি।’ বৈশাখ আমাদের কাছে উৎসবের পসরা নিয়ে হাজির হয়, গ্রাম, শহর সবখানে। এই উৎসবের আমেজের সঙ্গে মেলার পসরা তো আছেই। আছে ঐতিহ্যবাহী খাবার পান্তা-ইলিশ খাওয়া। অবশ্য এখন ইলিশ মাছের দাম হাতের নাগালের বাইরে। তবু্ও কোথাও কোথাও এর দেখা ও স্বাদ মিলবে। রসনাপ্রিয় বাঙালি এর স্বাদ নিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। উৎসবের রসনাবিলাসজনিত আরও একটি দিক রয়েছে এতদাঞ্চলে। সেটাকে বলা হয় পাচন রান্না এবং খাওয়া। বর্ষবিদায়ের দিন প্রকৃতি জাত সব ধরনের শাকসবজি মিলিয়ে যেখানে প্রচলিত ব্যবহৃত সবজির সঙ্গে অপ্রচলিত উদ্ভিজ্জ কাণ্ড, শাখা পাতা, ফুল, ফল দিয়ে অসাধারণ সুস্বাদু পাচন রান্না করা হয়। এই পাচন খাওয়ার উদ্দেশ্য হলো নতুন বছরের জন্য স্বাস্থ্যকে ইমিউন সিস্টেমে ঋদ্ধ করা, যাতে প্রত্যেকে রোগ-ব্যাধি থেকে প্রকৃতিগতভাবে মুক্ত থাকতে পারে। বিশ্বাস করা হয় যে, স্রষ্টার সৃষ্টিজাত প্রতিটি উপাদান মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়। তাই তো এই ইমিউনসমৃদ্ধ শাকসবজির মিলিত রান্না।
পহেলা বৈশাখ উদযাপন উৎসবের প্রধান আকর্ষণ মঙ্গলশোভা যাত্রা। ১৯৮৬ সাল থেকে সংস্কৃতিকর্মীদের শুভভাবনা থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হয়ে আজকের মঙ্গলশোভাযাত্রা। এই মঙ্গলশোভাযাত্রাকে বর্ণিল করে তোলার জন্য দেশীয় লোকজ উপাদানের তৈরি পুতুল, হাতি, ঘোড়া হরেক রকমের বিচিত্র অনুষঙ্গ এ মঙ্গলশোভা যাত্রার আকর্ষণীয় সৌন্দর্য। মঙ্গলশোভাযাত্রার আজকের অবস্থা, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, কট্টরবাদীদের চোখরাঙানি ও অনেক শুভবোধযুক্ত সংস্কৃতি কর্মীর প্রাণ-ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত ফসল। ভালো লাগার বিষয় হলো, এই নববর্ষ উদযাপনের মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের ইউনেসকোর মাধ্যমে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এ মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন একদিকে বিশ্বজনীন এবং অন্যদিকে এটি বর্ষবরণের নানা আয়োজন বাংলা সংস্কৃতির স্বকীয়তার প্রতীক। মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল উদ্দেশ্য আমাদের লোকশিল্প। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধরে রাখা। মঙ্গল শোভাযাত্রার সুসজ্জিত মিছিলে যে উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবার ঐতিহ্যগত সম্পদ। এটি আমাদের ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার একটা উপায়।
এবারের পহেলা বৈশাখ উদযাপন অধিকতর আনন্দময় হবে। সবার পরিধেয় লাল-সাদা রঙের পোশাক বৈশাখ উদযাপনকে রাঙিয়ে প্রকৃতির পথ-ঘাট, শহর, বন্দর, নগর অপরূপ সাজে সেজে উঠুক। শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?