clock ,

নিরাপত্তাহীনতার বিভীষিকা ও নারীদিবস

নিরাপত্তাহীনতার বিভীষিকা ও নারীদিবস

ইতিহাসের পরিক্রমায় এদেশে নারীসমাজ কখনোই সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল না, তবে বর্তমান পরিস্থিতি অতীতের সীমা অতিক্রম করতে চলেছে। নারী নির্যাতন সহিংসতা নতুন মাত্রা লাভ করেছে, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কারণে নারীরা এখন আগের চেয়েও বেশি অনিরাপদ বোধ করছেন। নারীদিবস এবার গভীর উদ্বেগ আতঙ্কের মধ্যে উদযাপিত হচ্ছে।

তুচ্ছ কারণেও নারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর লালমাটিয়ায় দুজন শিক্ষার্থীকে ধূমপানের অভিযোগে যেভাবে মব সৃষ্টি করে হামলা করা হলো, তাতে বিস্মিত হতে হয়। নারীর নিরাপত্তা বলে দেশে এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী বাইন্ডার মোস্তফা আসিফ অর্ণব কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে পোশাক নিয়ে হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়ে ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে অভিযোগ শাহবাগ থানায় মামলা করেন। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু দেখা গেল, ওই হয়রানিকারী ব্যক্তিটিকে শত লোক গিয়ে বীরের মর্যাদায় ছাড়িয়ে আনল। এর মানে হলো, আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা, মোরাল পুলিশিং এমনকি শারীরিক হামলার বিষয়গুলো সমর্থন পাচ্ছে। দীর্ঘ পাঁচ দশকের নারী আন্দোলনের উর্বর ক্ষেত্র এই বাংলাদেশে চিত্র সত্যিই খুব হতাশাজনক।

মাগুরায় বছরের একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে, শহরে ঘটছে, গ্রামে ঘটছে, বিরামহীনভাবে ঘটছে। অথচ এর যতটা প্রতিবাদ হওয়া দরকার ছিল, ততটা হচ্ছে না। আজ পর্যন্ত কোনো ধর্মবাদী সংগঠনকে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। ধর্ষণের ঘটনার ব্যাপারে কাউকে কোনো টু শব্দটি উচ্চারণ করতে দেখা যায় না। বরং এই ধর্মবাদীরা মব সৃষ্টি করছে এবং নারীদের উদ্দেশ্যে নিদান দিচ্ছে: মেয়েরা ওড়না ঠিক করো, রাস্তায় বিড়ি খেয়ো না, অফিসে কাজ করো না, পর্দা করো, রাস্তায় হেঁটো না, নিশ্বাস নিও না। তোমাদের কাজ শুধু পুরুষের ঘর সামলানো, ঘরে পুরুষের ভোগের সামগ্রী হওয়া, মনোরঞ্জন করা।

পৃথিবীর দেশে দেশে যখন নারী আন্দোলনের চতুর্থ ঢেউ উঠেছে, আমাদের দেশে তখন নারীরা পথেঘাটে ন্যূনতম নিরাপত্তার জন্য এখনও চিন্তিত। গণপরিসরে নারীর নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব ঘটনা নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা, স্বাধীন চলাচল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির নীরবতা এবং অপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকট হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ভ্রান্ত সামাজিক মূল্যবোধ নারীর স্বাধীন চলাফেরা, পোশাক, শিক্ষা এবং পেশার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে। মেয়েদের প্রতি নির্দিষ্ট আচরণ আরোপ করার প্রচেষ্টা এবংমোরাল পুলিশিং’-এর নামে নারীদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে নারীরা নিজেদের মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

শুধু হাটে মাঠে ঘাটে নয়, সর্বত্র নারী নির্যাতনকে বৈধ মনে করে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী। নারীকে নির্যাতন করলে তাদের কেউ চোখ রাঙাবে না, কোনও তিরস্কার করবে না। বিষয়ে তারা নীরব, বরং অপরাধীদের রক্ষায় সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। তারা অন্য ধর্মের প্রতি সহিংসতা, নারী নির্যাতন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুনকেও সমর্থন করে। বিভিন্ন উস্কানিমূলক মব সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করে রাখে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ধর্মবাদীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

অথচ আমাদের দেশে নারীরা আজ অন্য এক পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। ব্যক্তিস্বাধীনতা নিজেকের পরিপূর্ণভাবে বিকাশের জন্য লড়াইয়ে শামিল থাকার কথা ছিল। কিন্তু যৌন হয়রানি নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকেই এই দেশের নারীরা বের হতে হতে পারছে না। তাহলে তারা কীভাবে উন্নত জীবন গড়ার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করবে?

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর নারী আন্দোলনের দিকে তাকালে নিজেদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। তারা একের পর আন্দোলনের তরঙ্গ বা ঢেউ সৃষ্টি করছে। আর আমরা এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে পড়ছি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে বিংশ শতাব্দীর শুরুকে পশ্চিমী নারীআন্দোলনের প্রথম ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছিল আমেরিকা, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, কানাডায়। প্রধান দাবি ছিল, নারীদের ভোটাধিকার। ১৯৬০ সালে সূচনা হয় নারীআন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গের। সব রকম লিঙ্গবৈষম্য দূর করা, সব রকম কাজের অধিকার, প্রজনন গর্ভপাতের অধিকার, যৌনতার অধিকারের মতো দাবি সেই তরঙ্গের আঘাতে সামনে উঠে আসে। ১৯৯২ সালে রেবেকা ওয়াকার কলম ধরলেন অনিতা হিলের বিখ্যাত ঘটনা সম্পর্কে। অনিতা কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অভিযোগে করেছিলেন তার এক সময়ের উর্ধ্বতন ক্লেরেন্স থমাসের বিরুদ্ধে। ক্লেরেন্স থমাসের আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি হওয়ার পথে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত সেনেট ৫২-৪৮ ভোটে ক্লেরেন্স থমাস বিচারপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে নারীসমাজ। রেবেকা লিখলেন, ‘‘আমি উত্তর নারীবাদ। নারীবাদী নই। আমিই তৃতীয় তরঙ্গ।’’ ধীরে ধীরে তৃতীয় তরঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, পারিবারিক হিংসারোধ, বৈবাহিক ধর্ষণের মতো বিষয়। নানা ধরনের দাবির কারণে, আন্দোলনের কাঠামোটি ধীরে ধীরে ব্যক্তিবাদী আকার নিয়েছে।

প্রথম তরঙ্গে যেমন আইনি লড়াইয়ের জয় এসেছিল, দ্বিতীয় তৃতীয় তরঙ্গেও কিছু ক্ষেত্রে তা ঘটল। বাংলাদেশে নারী শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩ ২০২০) পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ সুরক্ষা) আইন, ২০১০, কর্মক্ষেত্রে নারীর যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ) নীতিমালা, ২০১২, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। সমীক্ষা বলছে, শতকরা আশি শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বা অবাঞ্ছিত স্পর্শের শিকার হন। আবার ঘরেও অন্তত ৮২ ভাগ নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। আইন প্রণয়ন করলেই সমস্যার সমাধান হয় না, বরং এর বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করাটাই মুখ্য। এখানে বাংলাদেশে চরম ঘাটতি দেখা যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খোলাখুলি কথা বলা নিয়ে নারী আন্দোলন শুরু হয়েছে। নিন্দা বা অভিনন্দনের তোয়াক্কা না করেস্লাট ওয়াক’-এর মতো মুভমেন্ট, ‘দ্য ভ্যাজাইনাল মোনোলগস’-এর মতো নাটক, সিনেমা তৈরি হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে মেয়েদের সব রকম ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় আসতে শুরু করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এইসব ঝাপটা।মি টুআন্দোলন তো দুনিয়াজুড়ে ঝাঁকুনি দিয়েছে।

সমাজতান্ত্রিক, চরম, ইনটারসেকশনালতাত্ত্বিক দিক থেকে নারী আন্দোলন নারীবাদের অনেক রকম কাঠামো, শাখা আছে। সে সব কথায় গেলে, যে কথাটা বলা জরুরি তা বলা হয়ে উঠবে না। উত্তরউত্তর-আধুনিকসময়ে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বায়নের পরে সমাজে যে বিরাট আর্থ-সামাজিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে তার কারণে আগের মতো মেয়েদের সার্বিক ভালোমন্দ নিয়ে আন্দোলন দানা বাঁধছে না। এখন নারীবাদী বিষয়গুলোর দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। সমাজের উপরতলা যখন পোশাক পরার স্বাধীনতার সন্ধান করছে, তখন অন্য অংশ লোকাল বাসের ভিড়ে তার শরীরটা বাঁচাতেই ব্যস্ত। সমাজের উপরতলা যখন পরিবারের ভেতরে শ্রমের সাম্য খুঁজছে, নিচের তলা তখনও মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে চাইছে।

সমাজের দুই অংশের সংলাপ মধ্যবর্তী শূন্যতায় আটকে যাচ্ছে। দুটি আলাদা ঘূর্ণি, দুটি আলাদা বৃত্তে ঘুরছে। দুটি কণ্ঠস্বর মিলছে না। নারীসমাজের মিলিত কণ্ঠ হয়ে উঠতে পারছে না। মেয়েদের দাবি অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক বৈষম্য ধূ ধূ মাঠ রেখেছে পেতে। যা পেরনো কঠিন। তাই নারীবাদী লড়াইয়ের আগেই এসে যাচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। যেখানে এই ফারাক নেই, সেখানে সমাজে অনুরণন উঠছে। হচ্ছে প্রতিবাদ। যেমন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই। এই নারীবাদের লড়াইয়ে পুরুষদের সঙ্গে নিতে হবে। দল ভারী করেত হবে।

নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং সমানাধিকারের জন্য একটি নতুন চতুর্থ তরঙ্গের প্রয়োজন। এটি শুধুমাত্র নারী অধিকার নয়, বরং মৌলবাদ, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এই তরঙ্গই পারবে নারীদের একত্র করে একটি সমানাধিকারভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে।

আমরা অপেক্ষা করছি সেই নতুন পরিবর্তনের, যা নারীকে প্রকৃত অর্থেই নিরাপদ, সম্মানজনক স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার দেবে। এজন্য কোমড় বেধে লড়াইয়ে নামতে হবে। লড়াই ছাড়া আক্রান্তদের বাঁচার অন্য কোনো পথ নেই।

 লেখক :  লেখক  নিবন্ধকার

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য