সম্প্রতি ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসটি (১৯১৬) নতুন করে পড়তে এবং ছবিটি (১৯৮৪) নতুন করে দেখতে হল। ফলত এই অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথের কথা বীণার মতো বাজল: ‘নতুনকে দেখতে হলে একটু বিশেষ করে বাতি জ্বালতে হয়।’ দেখলাম কী ভাবে বাহির এসে ঘরকে ছোঁয়, ঘর মেশে বাহিরে, অন্তঃস্যূত হয়ে যায় পরস্পরের মধ্যে, সংযুক্ত হয়, অথবা পারে না। তৈরি হয় মিথ্যের দেবালয়। আজ ধর্ষণ, মৃত্যু, সাম্প্রদায়িকতা আর অন্ধ ধনাভিমানের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে, নিখিলেশের সঙ্গে আর এক বার আমাদের দেখা হোক।
পেনেটির বাগানবাড়িতে বালক রবীন্দ্রনাথকে হাতছানি দিয়েছিল গঙ্গা। সেই তাঁর ‘বাহিরে যাত্রা’র শুরু। তাঁর জীবনের একটি প্রধান সত্য: ‘বিশ্বকে আমার চাই, নইলে আমি বাঁচিনে।’ ঘর ও বাহিরের জটিল বিপ্রতীপতাকে আপন সত্তায় মেলানোই যে তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের অন্যতম প্রধান সূত্র, বিশ্বভারতীর ভাবনা যে আসলে বিশ্বের সঙ্গে ভারতকে, ভারতের সঙ্গে বিশ্বকে সমন্বিত করার ঐকান্তিক প্রয়াস, তা প্রকৃত রবীন্দ্রপাঠক জানেন। জাতীয়তাবাদ-বিরোধিতা এই বিশ্বভাবনার অঙ্গ। নিখিলেশ বলেছিল: ‘আমি যে কোনো নেশাতেই বিশ্বাস করি না সন্দীপ।’
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পশ্চাদ্পটে ‘ঘরে-বাইরে’ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বদৃষ্টির মুখপত্র হয়ে ওঠে। সমাজ, রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ, নারীমুক্তি, প্রেম তথা মানবমন নিয়ে এমন বহুকৌণিক বিতর্ক সংবলিত পত্র-উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক শৈল্পিক বিস্ময়। আমরা লক্ষ করব, সত্যজিৎ রায় ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকেই (অর্থাৎ ‘পথের পাঁচালী’র সাত-আট বছর আগে, যখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬-২৭) ‘ঘরে-বাইরে’ নিয়ে ছবি করার কথা ভেবেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই উপন্যাসটিই কেন? অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতার সময় থেকেই এই উপন্যাসের বহুমাত্রিক বিতর্ক তাঁর কাছে জরুরি মনে হয়েছে। অবশেষে ১৯৮৪ সালে শেষ পর্যন্ত এই ছবি করে ছাড়লেন তিনি। যেন তাঁকে করতেই হবে, করার জন্য তিনি দায়বদ্ধ।
কেন? কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজে যেমন অভ্রান্ত ভাবে নিখিলেশ, রনেসাঁসের ঐতিহ্য নিয়ে সত্যজিৎও তেমন। বিমলা আর নিখিলেশের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার দৃশ্য চলচ্চিত্রের ইতিহাসের স্মরণীয়তম দৃশ্যগুলির একটি। ওই দৃশ্যটি আমাদের সমাজেতিহাসের একটি দীপচিহ্ন। সত্যজিৎ, এবং অভ্রান্ত ভাবে সত্যজিৎ, ছাড়া এই ছবির ভাবনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া আর কোনও চলচ্চিত্রকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিখিলেশ চরিত্রের নৈর্ব্যক্তিক ‘এলিভেশন’ আমরা মতবাদ-খণ্ডিত বাঙালিরা কোনও দিন বুঝেছি কি না, বোঝার চেষ্টা করেছি কি না জানি না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাবধান করেছিলেন: ‘বুলিটা যেন বাটখারা না হয়।’ বুলি ছাড়া আজ আমরা প্রায় সর্বস্ব খুইয়েছি।
এই সব-খোয়ানোর সাবধানবাণী বার বার উচ্চারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আমরা কান দিইনি। গোরা উপন্যাসে পল্লির মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সত্যকে সে কোনোপ্রকার আবরণের ভিতর দিয়া দেখে না।’ আমরা সেখান থেকে কিছুই শিখিনি। রবীন্দ্রনাথের এই বেদনা তো নিখিলেশের প্রতিটি বাক্যের খাঁজে লুকিয়ে আছে। বিমলা বলেছিল তার স্বামীর অন্তরের বেদনার কথা।
সত্যজিতের ছবিতে দেখি, ‘কাছারি ঘরে বসা নিখিলেশের মুখ। গভীর বেদনার ছাপ পড়েছে তার চাহনিতে।’ (চিত্রনাট্য থেকে)
একটি সূক্ষ্ম দৃশ্যে আছে: ‘(নিখিলের স্টাডি)
নিখিল: কী খুঁজছেন, মাস্টারমশাই?
মাস্টারমশাই: প্যাসিফ্লোরা। ছিল না তোমার কাছে?
নিখিল: আপনার ঘুম হচ্ছে না?
মাস্টারমশাই: বয়সের সঙ্গে ঘুম তো এমনিতে কমে আসে। তবে গত তিন রাত্তির—
নিখিল: ওটা আপনার কাছে রেখে দিন।’
অর্থাৎ এই উন্মত্ত পৃথিবীতে নিখিলেশেরও ঘুম আসে না। নইলে সে ‘প্যাসিফ্লোরা’ রাখে কেন? পুরো ছবির বুক ছিঁড়ে (মিস গিলবির শেখানো) বিমলার সেই বেদনার্ত সুর বাজতে থাকে: ‘Long, long ago—long, long ago…/Sing me the song I delighted to hear.’
বিমলা তার আত্মকথায় লিখেছিল: ‘আমার স্বামীর বড়ো ইচ্ছে ছিল আমাকে বাইরে বের করবেন। একদিন আমি তাঁকে বললুম: বাইরে আমার দরকার কী? তিনি বললেন, তোমাকে বাইরের দরকার হতে পারে।’ বিমলা আরও লিখেছিল: ‘আমার স্বামী আমাকে জোর করে কেন নিয়ে গেলেন না? আমি জানি কেন। তাঁর জোর আছে বলেই জোর করেননি।’
সত্যজিতের ছবিতে নিখিলেশের পায়চারি করার ক্ষুব্ধ, উৎকণ্ঠিত দৃশ্য তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ’ জীবনচিত্রে জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের পর পিছনে মুষ্টিবদ্ধ হাতে রবীন্দ্রনাথের পায়চারি করার অবিস্মরণীয় দৃশ্যের কথা মনে করায়। উৎকণ্ঠা! সন্দীপদের নিয়ে, যারা ‘দেশহিতৈষী’ জাতীয়তাবাদীর ছদ্মবেশে দেশের সর্বনাশ করে দিতে পারে। ১৯১৬ নয়, মনে হয় ২০২৫ সালের ভাষ্য শুনছি। ভবিষ্যদ্দৃষ্টি আর কাকে বলে! কিছুতেই বড় করে ভাবতে না পারা লুকাচ বলেছিলেন, এটি একটি ‘লায়বেলিয়াস প্যামফ্লেট’; অন্য দিকে, প্রকৃত মানবপন্থী ব্রেশট ধরতে পেরেছিলেন ‘ঘরে-বাইরে’র শক্তির কথা। আর আমরা? এক মেঘমেদুর রোম্যান্টিসিজ়মের বাইরে বেরোতে পারিনি।
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিরক্তি এই ভাষায় প্রকাশ করেছেন, ‘যে ভারতমাতা, যে ভারতলক্ষ্মী কেবল সাহিত্যের ইন্দ্রধনুবাষ্পে রচিত, যাহা পরানুসরণের মৃগতৃষ্ণিকার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, তাহার চেয়ে নিজের সংসারটুকু যে ঢের বেশি প্রত্যক্ষ, নিজের জঠরগহ্বরটা যে ঢের বেশি সুনির্দিষ্ট।’ (‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’, বৈশাখ ১৩১২) আজ শতাধিক বছর পরে ‘ঘরে-বাইরে’ পড়তে গিয়ে দেখি নিখিলেশ লিখেছে: ‘কত ভাঙা আয়না, বাঁকা আয়না, ধুলোয় অস্পষ্ট আয়না। যখনই বলি, ‘আয়নাটা আমার করে নিই’, ‘বাক্সের ভিতরে করে রাখি’ তখনই ছবি সরে যায়। থাক না, আমার আয়নাটাই বা কী, আর ছবিতেই বা কী।’
এই দার্শনিক সারসত্যটুকু সন্দীপেরা বোঝেনি। সন্দীপ বলে: ‘যেটুকু আমার ভাগে এসে পড়েছে সেটুকুই আমার, একথা অক্ষমেরা বলে আর দুর্বলেরা শোনে। যা আমি কেড়ে নিতে পারি সেটুকুই আমার যথার্থ আমার, এই হলো সমস্ত জগতের শিক্ষা। দেশে আপনা-আপনি জন্মেছি বলেই দেশ আমার নয়। দেশকে যেদিন লুঠ করে নিয়ে জোর করে আমার করতে পারব সেইদিনই দেশ আমার হবে।’ আমরা স্তম্ভিত হয়ে শুনছি সন্দীপ বলছে: ‘আজ ধিক্ থাক্ সেই ধর্মকে যা হাসতে হাসতে সর্বনাশ করতে জানে না।’ বিমলা তাকে উদ্ধৃত করে: ‘এসো পাপ, এসো সুন্দরী।… অকল্যাণের বাজুক শঙ্খ/ললাটে লেপিয়া দাও কলঙ্ক…।’ সন্দীপ আমাদের হতবাক করে বলে: ‘লাভ করার স্বাভাবিক অধিকার আছে বলেই লোভ করা স্বাভাবিক। কোনও কারণেই কিছু থেকে বঞ্চিত হব, প্রকৃতির মধ্যে এমন বাণী নেই।’
নিখিলেশের বিশ্লেষণে আছে এর উত্তর: ‘আমি অনেক দিন থেকেই লক্ষ করেছি, সন্দীপের প্রকৃতির মধ্যে একটা লালসার স্থূলতা আছে। তার সেই মাংসবহুল আসক্তিই তাকে ধর্ম সম্বন্ধে মোহ রচনা করায় এবং দেশের কাজে দৌরাত্ম্যের দিকে তাড়না করে। তার প্রকৃতি স্থূল অথচ বুদ্ধি তীক্ষ্ণ বলেই সে আপনার প্রবৃত্তিকে বড়ো নাম দিয়ে সাজিয়ে তোলে। ভোগের তৃপ্তির মতোই বিদ্বেষের আশু চরিতার্থতা তার পক্ষে উগ্ররূপে দরকারি।… দেশের সম্বন্ধে সন্দীপের মনের ভাবের অনেকখানিই সেই স্থূল লোলুপতার রূপান্তর।’ নিখিলেশের কথায়, ‘ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি সন্দীপ হচ্ছে আইডিয়া জাদুকর; সত্যকে আবিষ্কার করায় ওর কোনো প্রয়োজন নেই, সত্যের ভেলকি বানিয়ে তোলাতেই ওর আনন্দ।… যাই হোক, দেশের মধ্যে মায়ার এই তাড়িখানা বানিয়ে তোলায় আমি কিছুমাত্র সাহায্য করতে পারব না। প্রমত্ততা থেকে দেশকে যদি বাঁচাতে না পারি, তবে দেশের পূজা হবে দেশের বিষনৈবেদ্য, দেশের কাজ বিমুখ ব্রহ্মাস্ত্রের মতো দেশের বুকে এসে বাজবে।’
আজ শতাধিক বছর পরে, যখন এই জোর করে আদায় করার মসীকৃষ্ণ রাজনীতি আমাদের অতি-পরিচিত, তখন বহুরূপী, দ্বিজিহ্ব সন্দীপদের চিনতে ভুল হয় না। নিখিলেশ কোথায়? যে বলতে পারবে, ‘আমি জীবনপুরের পথিক। দুঃখের ভিতর দিয়ে যে মুক্তি আসে, সেই মুক্তি দুঃখের চেয়ে বড়ো।’ যে বলতে পারবে: ‘(গরিব মুসলমান প্রজাদের) ওপর কোনোরকম অত্যাচার হোক আমি চাই না। যদি দেখি সেটা হচ্ছে তাহলে কিন্তু আমি বাধা দেব। মুসলমানদের বাদ দিয়ে ভারতবর্ষ কল্পনা করা যায় না।’
‘ঘরে-বাইরে’ ছবির শেষ দৃশ্য:
‘নিখিল: আমায় যেতেই হবে! বাধা দিও না।
মাস্টারমশায়: তোমরা ওকে যেতে দিলে?
— আমরা তো বারণ করলাম! উনি তো শুনলেন না।
ঘোড়ার খুরের শব্দ।
বিমলার টিপ, সিঁথির সিঁদুর, গয়না, সবকিছু মিলিয়ে যায়। ক্যামেরা ফিরে এসে তাকে ধরে।
বিমলার পরনে থান।’
মুক্ত মানবতার মৃত্যু হয়েছে। শুধু আছে বহুজিহ্ব রাজনীতিকদের বাসরঘরি নাচ। ১৯৮৪ সালে যখন সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রায়িত করেছেন ‘ঘরে-বাইরে’, তখন এ কথা যতটা সত্য, আজ উপন্যাসের শতাধিক বছর পরে সম্ভবত তার চেয়েও বেশি। এই শরাচ্ছন্ন সংশয়ের মুহূর্তে ‘রাত্রিবেলাকার শব্দ যে কতরকম ছদ্মবেশ ধরে তার ঠিকানা নেই’ (‘ঘরে-বাইরে’, শেষ পৃষ্ঠা)। এখন মানবমর্যাদার কথা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন আমাদের?
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?