বাঙালি হয়ে ও আমাকে বলতেই হবে যে হোলি ( আমরা দোল বলতাম না) আমাদের কাছে ঠিক দূর্গা পুজোর মতন যেমন ভীষণ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল ঠিক তেমনই প্রচন্ড আনন্দের উৎসব ছিল।
আমার ছোট বোনেদের জন্যে রং খেলা আর বন্ধুর বাড়ি হোলি মিলন করতে যাওয়াটাই বড়ো ব্যাপার ছিল , যদিও আমার ভাইয়ের কাছে বন্ধু -বান্ধবদের সাথে হোলিকা-দহনের দিন মানে দোল পূর্ণিমার রাত ও বিরাট হুজুগের ব্যাপার ছিল ।
ছেলের দলেরা গাধার লাজে ভাঙা ক্যানিস্টার বেঁধে তাকে রাস্তায় ছোটানো আর সেই গাধার রাস্তায় সেই কনেস্টের টা ঘড় -ঘড় করতে করতে ছুটে যাওয়া ও তারসাথে ছেলেদের ছোটা ও চিৎকার করে স্লোগানের মতন বলা , "বুরা না মানো হোলি হায় !" আমরাও বাড়ির জানলা দিয়ে দেখে মজা করতাম।
দোল পূর্ণিমার রাতে ১২ টার সময়ে হোলিকা-দহন করার পর্বটা ও একটা বিশাল উত্তেজনার বিষয় ছিল। এলাহাবাদের হালকা ঠান্ডায় দোল পূর্ণিমার রাতে আগুনের চারপাশে বসে হোলিকার পুত্তলিকা কে আগুনে দহন করাও এক বিশাল রকমের অনুষ্ঠান, সেটা যারা উত্তর প্রদেশের হোলি উৎসব দেখেননি তারা এই দৃশ্য কল্পনাও করতে পারবেন না।
ওখানকার স্থানীয় মহিলারা পুজোর থালায় হোলির উপলক্ষে বানানো নানারকমের খাবার অগ্নি দেবতা কে উৎসর্গ করে ও পুজো করে তবেই সেই খাবারের স্বাদ নিতেন। বেশ কদিন ধরে রান্না করলেও এই হোলির অগ্নি কে সেই খাবার উৎসর্গ না করে খাবারের স্বাদ নেওয়ার নিয়ম নেই।
কারণ এই অগ্নি দেবতা দুষ্টের দমন করে সত্যের জয় করিয়েছিলেন । বাঙলায় কৃষ্ণের দোল খেলার সাথে এই পর্বটি কে পালন করা হয়। কিন্ত ইউপিতে প্রহ্লাদের অগ্নিকুণ্ড থেকে জলজ্যান্ত
বেরিয়ে আসাটা কে সত্যের জয়ের প্রতীক মনে করে উৎসবটি পালন করে, বিশেষ করে দুষ্টের দমন মানে হোলিকার আগুনে ভস্ম হয়ে যাওয়াটাকেই উদযাপন করে। আর এই হোলিকা থেকেই হোলি শব্দটির উৎস।
হোলিকা দহনের পরের দিন সকাল হতেই সেই হৈ-হৈ, রৈ-রৈ চারদিক দিয়ে শুরু হয়ে যেত , ঢোল -টিন পিটিয়ে ছেলেদের দলেদের বেরোনো আর চিৎকার করে বলা , "বুরা না মান হোলি হায়!"
সব পাড়াতেই হতো কিন্তু এই ব্যাপারে আমাদের পাড়াটা একটু আলাদা ছিল। সব কিছু একটু বেশি রকমের হুজুগের সাথে পালন করা হতো।
আমার মা ও বাবা দুজনেই উত্তর-কলকাতার মানুষ ছিলেন, বাবা কিছু বলতেন না কিন্তু মা বলতেন , "বাবা এই রকম দোল খেলা তো আমরা কোলকাতায় কখনো দেখিনি !" এমনকি কলকাতা থেকে আত্মীয় স্বজনেরা এলাহাবাদের হোলি দেখে অবাক হতেন আর সেই স্মৃতি ভুলতে পারতেন না।
আমার কথায় আসি। এই সময়ে সব অবাঙালি মানে ইউ পির অবাঙালিদের কথা বলছি - প্রায় এক মাস আগে থেকে তোড়-জোড় শুরু হতো, ঠিক আমাদের দুর্গাপুজোর তোড়জোড় করার মতন। নতুন জামা কাপড় কেনা, সেলাই করা বা করতে দেয়া , ছুটিতে কতদিনের জন্যে কে আসবে এ সব তো ছিলই। তার সাথে আর একটা বিরাট তোড়-জোড় চলতো সেটা হলো হোলির উপলক্ষে নানা রকমের খাবার বছর খানেকের জন্য বানিয়ে রাখা। আলু কা পাঁপড়, চাওল কা পাঁপড় , সাবুদানা কা পাঁপড়, আলু কে চিপ্স জালিদার আউর সাদা বানিয়ে পুরো এক বছরের জন্য ক্যানিস্টারে ভরে-ভরে রেখে দেয়া আর সেগুলো হোলির সাথে সারা বছর ধরে খাওয়া হোত ।
এই সময় এলাহাবাদ এ আলু খুব সস্তা হয়ে আর ৩০-৪০ কিলো মতন আলু কিনে বাড়িতে- বাড়িতে লোকে পাঁপড় ও চিপ্স বানিয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে রেখে দেয় এবং তার সাথে বৈচিত্র আনার জন্যে চালের ও সাবুর পাঁপড় ও বানিয়ে , শুকিয়ে তোলা হয়ে ক্যানিস্টার ভরে । অনেকের আবার চালের ও সাবুর পাঁপড়ে খাবার রঙ মিশিয়ে নানা রঙের ও করতেন। এই সব কিন্তু হোলির উপলক্ষে করা হয়ে এবং ওই সময়ে লোকজন হোলি-মিলন করতে এলে খেতে দেয়া হোত। সাথে আর একটা বড়ো এবং অপরিহার্য মিষ্টি পরিবেশন করা হবেই হবে। সেটা এই সময়ে সব বাড়িতে তৈরী হতো নানা রকমের পুর দিয়ে। নাম তার গুজিয়া, আমরা বাংলায় বলি পিরাকী। আজকাল শুনেছি এগুলো রেডীমেড মিষ্টির দোকানে পাওয়া যায়, লোকেদের এসব করার সময় নেই। যেমন আজকাল আমাদের পাটিসাপ্টা দোকানে পাওয়া যায় ।
লোকেরা গুজিয়া, পাঁপড় চিপ্স কিনে আনে কিন্তু এখনো সব বাড়িতে বিরাট স্কেলে না বানিয়ে, কম করে গুজিয়া বানাবেই তার পেছনে ধর্মীয় কারণ আছে। প্রথমত হোলিকা দহনে অর্ঘ দেয়া হবে আর দ্বিতীয়ত বাড়ির মঙ্গলের জন্য। তবে আগে আমাদের পাটিসাপ্টা বা পিঠে -পুলি মতন এগুলো বাড়িতেই বৃহৎ স্কেলে করা হতো । সেটা হলো, গুজিয়া অনেক রকমের পুর দিয়ে আবার অনেক বাড়িতে তাদের নিজস্ব রেসিপি থাকে। তবে সাধারণত ক্ষীরের / খোয়া/মাওয়া পুর দেওয়া , সুজির পুর দেওয়া ও নানা রকমের ড্রাই ফ্রুইটস মিলিয়ে পুর দেওয়া বানায়। তার সাথে আবার খোলটা দু রকমের হতো একটা চিনির রসে চুবানো আর একটা রস বিহীন। ক্ষীরের পুর দেওয়া টা ৩-৪ দিনের জন্যে করা হতো কারণ ক্ষীর পচে যাবার সম্ভাবনা থাকে । সুজিরটা বেশিদিন থাকে আর পুরটা ক্ষীর ও ড্রাই ফ্রুইটস এর চেয়ে সস্তা বলে বেশি করে অনেক জন, বিশেষ করে কাজের লোকদের ও সবজিওয়ালা, প্রেসওয়ালা/ ইস্ত্রিওয়ালাদের দেওয়ার জন্যে বানানো হতো আর বাকিগুলো বাড়ির লোকজন , আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু -বান্ধবদের জন্য বানানো হতো।
এই গুজিয়া নিয়ে কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে নানা আলাপ-আলোচনা ও পাঁচাও চলতো । সেইটা বন্ধুদের কথায় জানতে পারতাম ও শুনতাম। এই নিয়ে আমি এলাহাবাদের নাম করা হিন্দি খবরের কাগজ ,"অমৃত প্রভাত"রম্য রচনাও লিখেছিলাম। কাদের বাড়ির কেমন গুজিয়া হয়ে - কে গুজিয়া তে কতটা পুর দিয়ে বানায়ে, কাদের বাড়ির গুজিয়ার খোলটায় ময়ান দেয়া হয়না বা এতো শক্ত যে খাওয়া যায়না বা সাইজ ছোট হয় ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আবার পাঁপড়- চিপ্স বানানো একটা উৎসবের মতন ছিল। এ এক বৃহৎ কাজ সেটা চলতো মাসখানেক ধরে আর সেটা একজনের পক্ষে সম্ভব ও নয় এবং একদিনের ও কাজ নয় । তাই সবাই পাড়ার লোকেদের জড়ো করে এই কাজ চলতো আর তার সাথে হাসি- ঠাট্টা , আড্ডা -গল্প-গুজব ও মজা। আমার আবার কি করে করছে বা বানাতে হয়ে , খুব শেখার ও দেখার চিরকালই এই শখ ছিল ও এখনো আছে ।
তাই আমাদের প্রতিবেশী দুবেজির বৌ যাঁকে আমরা ভাবি বলতাম, তাঁর বাড়িতে যেতাম আরও পাড়ার কয়েক বন্ধুদের সাথে আর তাঁর সাথে সব রকমের পাঁপড় ও চিপ্স বানানোর কাজে যোগ দিতাম। আমি সে সব এখনো বানাতে পারি। ওই যে বলে যে কোনো কিছু যদি নিজের হাতে করে শেখা হয়ে, সেটা ভুলে যাওয়াটা সহজ নয় ।
শুধু হোলির খাওয়া ও রঙ খেলা ই নয়।
এগুলো দিনের বেলায় করা হতো আর ছুটির দিনে যখন আমাদের স্কুল বন্ধ থাকতো। এলাহাবাদে কিন্তু স্কুল - কলেজ বেশ কিছুদিন ধরে হোলির উপলক্ষে বন্ধ থাকতো। এই সব পাঁপড় ও চিপ্স বানিয়ে খাটিয়াতে পাতানো পরিষ্কার কাপড়ের ওপর শুকোতে দেয়া হতো। সারাদিন চড়া রোদে শুকিয়ে যেত আর ক্যানিস্টারের ভেতর পুরে রাখতেন গৃহিণীরা। হোলির সময় বার করে ভাজা হবে তখন সবাই খাবে। যদিও অর্ঘ হিসেবে হোলিকা দহনের অগ্নিতে দিয়ে তারপর।
হাঁ, আরেকটা কথা আমাদের ইংরেজি ও হিন্দি সিলেবাস এর খুব লোকপ্রিয় essay লিখতে হতো , 'হোলি কা তেয়োহার' আর ইংরেজি তে 'হোলি ফেস্টিভ্যাল'। এখনো হুবহু মনে আছে প্রতিটা বর্ণনা , এতো বার লেখা হতো যে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলোl তার সাথে স্কুলের অ্যাসেম্বলি তে আমরা হোলির আগে -আগে হোলি নিয়ে নাটক , নাচ-গান, হাসির চুটকি বলা ইত্যাদি উৎসব করতাম। এখনো গানগুলো মনে আছে যেমন ,
" হোলি খেলে রঘুবীরা , আউধ মে হোলি খেলে রঘুবীরা,
রাম কে হাথে কনক পিচকারি , লক্সমান কে হাথে আবিরা,
আউধ মে হোলি খেলে রঘুবীরা !"
এলাহাবাদে রামের হোলি উৎসব পালন করার গল্প ও গান কৃষ্ণের চেয়ে বেশি হয়।
যা দারুন নাচ আর মজা হতো আবির উড়িয়ে , সেটা বলে বোঝানো কঠিন !
ওদিকে হোলির দিন কাছাকাছি এলে কিছু লোকেরা একজোট হয়ে পাড়ার কিছু লোকেরা লুকিয়ে গালাগালি বা অশ্লীল ভবিষ্যদ্বাণী লেখা রাশিফল বার করে এক -এক জনের বাড়ি ফেলে আসতো। কারা করতো সেটা কেউ জানতো না। সেটা আবার সবার সাথে হতোনা , বিশেষ কিছু লোকেদের সাথে যাদের ওপর সেই গ্রুপের লোকেদের রাগ থাকতো।
দোল পূর্ণিমার পরের দিন হোলি খেলা হতো দুদিন ধরে। আমরা পিচকিরি ও বালতিতে রঙ নিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লোকেদের গায়ে রঙ দিতাম তারা ও আমাদের গায়ে দিতো । পরে বালতি বাড়িতে রেখে , হাতে পিচকিরি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম দলবলের সাথে ও মধ্যে। একটা সাইরেন বাজানো হতো পুলিশ স্টেশন থেকে দুপুর ১টা -১ ১/২ টা সময়ে , তারপরে আর হোলির রঙ খেলা বারণ ছিল।
তারপর আমরা বাড়ি এসে স্নান করে খাওয়া দাওয়া সারতাম আর বিকেলে হোলি-মিলন করতে বন্ধুদের বাড়ি যেতাম. তখন একজন আরেকজন কে আবির লাগিয়ে তাদের পরিবেশন করা হোলির খাবার খাওয়া হতো। এটা শুধু ইউ পির বন্ধুদের বাড়ি তে হোত । ওরা একটা বড়ো স্টিলের কাঁদা-উঁচু থালায় পাঁপড় ভাজা , চিপ্স ভাজা আর কয়েকটা গুজিয়া দিতো । সবার নজর গুজিয়ার দিকে কারণ আমরা হয়তো ৬ জন গেছি ওরা ৪ টি গুজিয়া দিয়েছে । কে আগে তুলবে , যে লজ্জা পেতো সেই ঠকতো। এগুলো ছোট বেলায় কথা।ওরা কখনো আমাদের মতন বিজয়ার খাবার দেয়ার মতন করে এক -এক জনের ভাগ আলাদা প্লেট সাজিয়ে দিতো না। যদিও বড়ো হয়ে হোলি মিলন করতে গেলে এই সব খাবার এক থালায় দিলেও দহিবড়া বা আলু টিকিয়া টা সবাই আলাদা করে দিতো। আমরাও ওদের বিজয়াদশমী তে খাবার খাওয়াতাম আর ওরা আমাদের হোলিতে যেতে বলতো।
প্রতিবেশী সেই ভাবীদের বাড়ি থেকে থালা ভরে পুরি , কচুড়ি , সব্জি , ক্ষীর , গুজিয়া আসতো বেশ বড়ো থালাতে। যে হেতু আমরা ওদের বেশ নিকট প্রতিবেশী ছিলাম ।
একটা মজার ব্যাপার হতো হোলির সময়ে ভাবীর ভাই যখন এই সব দিতে আসতো তখন বাবা আর মা কে বিশেষ একটি কচুড়ি খাবার জন্যে বেশ সাধাসাধি করতো। একবার মনে আছে বাবা সেই কচুড়ি খেয়ে অকারণে খুব হাসছিলেন। পরে জানাগেলো সেই কচুড়িটাতে ভাঙের পুর দেয়া ছিল বেশ মশলাদিয়ে মাখা। বাবা বুঝতে পারেননি । অনেকের বাড়িতে ভাঙ দেওয়া ঠান্ডাই/ দিতো।এগুলো কিন্তু কৌতুক করা হয়ে আর সাথে থাকে কাগজে লেখা স্লোগান ," বুরা না মান হোলি হায় !"
যখন বড়ো হয়ে কলেজ এ গেলাম তখন কিন্তু আমরা মেয়েরা হোলির বেশ কিছুদিন আগে থেকে কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিতাম কারণ ছেলেরা যে কোনো সময়ে বেলুনে রঙিন জলের পুর দিয়ে সেই বেলুন জোরে ছুঁড়ে মারতো , যতোনা রঙের ভয়ে পেতাম তার চেয়ে তিনগুন ভয়ে পেতাম, গায়ে ব্যাথা লাগার। কারণ জলভরা বেলুন বেশ ভার হয়ে যায় আর খুব জোরে থপাস করে এসে ঘাড়ে বা পিঠে পড়তো আর বেশ ভালো রকমের ব্যথা লাগতো। আমার এক বন্ধু এই ব্যাথার ভুক্তভোগী হয়েছিল। কলেজের কয়েকটা অভদ্র ছেলেরা অশ্লীল কার্ড দিতো প্রফেসসরদের আর সেটা আবার পড়ে-পড়ে ক্লাসে শোনাতো।
তারপর যখন কলেজে পড়াতে গেলাম তখন ছুটির পর সব ইউ পির সহকর্মীরা লাঞ্চ এ ভালো ভালো নানা পদের কিন্তু একই হোলির খাবার নিয়ে আসতেন আর আমরা সবাই মজা করে খেতাম। এই সবই স্মৃতি শুধায়ে ভরা আছে ও থাকবে ।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?