শান্ত হ্রদ, বিস্তৃত বরফের মরুভূমি, প্রাচীন বৌদ্ধ মঠগুলি ঘুরে দেখা ছাড়াও বিদেশিদের মধ্যে লাদাখে আসার একটি গূঢ় কারণ হল আর্যগ্রাম। সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, ‘আর্যগ্রাম’ বলে পরিচিত এই সব গ্রামে নাকি এখনও ভারতে যুদ্ধ করতে আসা গ্রিকদের বংশধরেরা বাস করেন। গ্রামে বাস করা ব্রোকপা বা দার্দ উপজাতির দাবি, তাঁরা আলেকজ়ান্ডারের সেনাদের বংশধর। এই উপজাতির শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ইউরোপীয় জনজাতির দৈহিক বৈশিষ্ট্যের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন ব্রোকপারা। কয়েক বছর আগে অবধি নিজেদের গ্রামে বহিরাগতদের পা রাখা পছন্দ করত না এই জনজাতি।
প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ বাস করেন লাদাখের প্রত্যন্ত গ্রামে। লাদাখের অন্যান্য মানুষের থেকে গঠনও সম্পূর্ণ আলাদা ব্রোকপাদের। তারা দেখতে মোঙ্গল বা তিব্বতিদের মতো নন। তাঁরা লম্বা, ফর্সা, তাঁদের লম্বা চুল, উন্নত চোয়াল এবং চোখের হালকা রং। ব্রোকপারা দাবি করেন তাঁরাই পৃথিবীর শেষ অবশিষ্ট বিশুদ্ধ আর্য। তাঁদের শরীরে বইছে খাঁটি আর্য রক্ত।
বিদেশিদের মধ্যে খাঁটি আর্য রক্তের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ রয়েছে। বিশেষ করে জার্মানির তরুণীরা চান তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম নীল চোখ, সোনালি চুল ও আর্যদের মতো দেহের গঠন নিয়ে জন্মাক। সেই টানে এই গ্রামের পুরুষদের ঔরসে সন্তানধারণ করতে লাদাখে চলে আসেন তাঁরা। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতি বছরই গ্রামে ভিড় করেন বিদেশি মহিলারা।
এই গ্রামগুলির হোম স্টে-তে তাঁরা থাকতে আসেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই লাদাখের গ্রামে ‘মাতৃত্ব পর্যটন’ বা প্রেগন্যান্সি ট্যুরিজ়মের ধারণা প্রচলিত আছে। যদিও এই বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পছন্দ করেন না স্থানীয়েরা। বরং এই বিষয়টি বেশ খানিকটা রহস্য মোড়াই রয়ে গিয়েছে। দ্রোকপারা তাঁদের জীবনযাপনকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতেই পছন্দ করেন।
২০০৭ সালে, চলচ্চিত্র নির্মাতা সঞ্জীব শিবানের ‘আচতুং বেবি: ইন সার্চ অফ পিউরিটি’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশিত হয়। সেই তথ্যচিত্রে, এক জন জার্মান মহিলা স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি ‘শুদ্ধ আর্য রক্তের’ সন্ধানে লাদাখে এসেছেন। শিবানের ছবিতে বলা হয়েছিল জার্মান তরুণী কেবল সন্তানধারণের মূল্য হিসাবে নগদ অর্থ দিতেই রাজি হননি, তিনি যাঁর সহায়তায় অন্তঃসত্ত্বা হতে চেয়েছিলেন সেই পুরুষের পরিবার এবং সন্তানদের জন্য উপহারও এনেছিলেন। ব্রোকপা সম্প্রদায়ের পুরুষেরা এই ব্যবস্থায় খুশি। তাঁরা জানিয়েছিলেন, এতে তাঁদের কোনও খরচ নেই ও হারানোর কিছু নেই। তাই এই কাজ চালিয়ে যেতে চান তাঁরা।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমগুলি দাবি করেছে, লাদাখের রাজধানী লেহ্ থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামগুলিতে চলছে ‘মাতৃত্ব পর্যটন’। তবে এই নিয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক প্রচার বা বিবৃতি না থাকায় এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যায়নি। ১৮৩০ সালে দ্রোকপাদের কথা প্রথম বাইরের জগৎকে জানান ব্রিটিশ অভিযাত্রী গডফ্রে থমাস ভিনিয়া। বহু যুগ ধরে নিজেদের ঘেরাটোপেই থাকতেন ব্রোকপারা। একেবারেই মিশতেন না বহিরাগতদের সঙ্গে। ১৮৭৫ সালে ভূতাত্ত্বিক ফ্রেডেরিক ড্রিউ ‘দ্য জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর টেরিটোরিজ়’-এ লেখেন তাঁদের কথা।
সাধারণত ইন্দো-ইরানি বংশোদ্ভূতদের আর্য বলা হত। কাদের আর্য বলা হবে সেই নিয়ে অবশ্য তর্কের অবকাশ রয়েছে। সে প্রসঙ্গে এখনও দ্বন্দ্ব কাটেনি। বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকেরা এখনও ধন্ধে, কাদের বলা হবে আর্য? নৃতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, নির্দিষ্ট কোনও জনজাতিকে কখনওই আর্য বলা যায় না। বরং ‘এরিয়ান’ হল একটি নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠী। ব্রোকপা জনজাতিতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল বিয়ে। কারণ প্রচলিত নিয়ম হল, নিজেদের গোষ্ঠীর বাইরে তাঁদের বিয়ে নিষিদ্ধ। তাঁরা এ ভাবেই রক্ষা করেন রক্তের ‘বিশুদ্ধতা’।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে ভারত অভিযানে এসেছিলেন আলেকজ়ান্ডার। সিন্ধু নদ অতিক্রম করে গ্রিক বীরের গন্তব্য ছিল গান্ধারের তক্ষশীলা। ভারত বিজয়ের স্বপ্ন অধরা রেখেই গ্রিসে ফিরে যেতে হয় আলেকজ়ান্ডারকে। কারণ দীর্ঘ অভিযানে তিনি নিজে ও তাঁর সেনাবাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তবে ফিরে যাওয়ার আগে তিনি কয়েক জন সেনাপতি-সহ সৈন্য রেখে যান ভারতে। সেই বংশধরেরা নাকি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়ে গিয়েছেন লাদাখ-সহ পাকিস্তানের কয়েকটি গ্রামে। আলেকজ়ান্ডারের সেনাবাহিনীর সদস্যেরাই আজকের ব্রোকপা জনজাতির পূর্বপূরুষ। লাদাখের উঁচু পাহাড়ে সিন্ধু নদীর তীরে, কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার (এলওসি) কাছে অবস্থিত ছোট ছোট গ্রামগুলিতে আস্তানা রয়েছে তাঁদের। ব্রোকপারা মূলত পাকিস্তানের গিলগিট বাল্টিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখোয়া, জম্মু ও কাশ্মীর এবং পূর্ব আফগানিস্তানের দার্দিক অঞ্চলে থাকেন। ‘ব্রোকপা’ নামটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘দারাদাস’ থেকে, যার অর্থ পাহাড়ের ধারে বসবাসকারী মানুষ।
শারীরিক গঠন, মৌখিক আখ্যান, লোককাহিনির উপর ভিত্তি করে নিজেদের খাঁটি আর্য বলে দাবি করলেও ব্রোকপাদের এই দাবির সত্যতা যাচাই করার জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। তাদের দাবির সত্যতা যাচাই করার জন্য কোনও ডিএনএ বা জিনগত পরীক্ষানিরীক্ষাও হয়েছে বলে শোনা যায় না।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?