clock ,

রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ২৭% হলেও ব্যাংক আমানত ৪ শতাংশে: আস্থাহীনতায় ভুগছে ব্যাংক খাত

রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ২৭% হলেও ব্যাংক আমানত ৪ শতাংশে: আস্থাহীনতায় ভুগছে ব্যাংক খাত

বাংলাদেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে প্রবৃদ্ধির হার ২৭ শতাংশেরও বেশি। প্রবাসী পরিবারগুলোর ব্যয় নির্বাহের পর রেমিট্যান্সের উদ্বৃত্ত অর্থ সাধারণত ব্যাংক আমানত হিসেবে জমা থাকার কথা। তবে, ব্যাংক খাতের আমানত প্রবৃদ্ধির চিত্রে এই প্রত্যাশিত প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশে হাজার ১৭৮ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় অর্থের পরিমাণ প্রায় লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। রেমিট্যান্স হিসেবে আসা অর্থের এক-তৃতীয়াংশও যদি ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা হতো, তাহলে তা ৮৮ হাজার কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে মাত্র ৭৫ হাজার ৮১৪ কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকে আমানত বেড়েছিল ৮০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, আগের বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছর হাজার ৯৭৮ কোটি টাকার আমানত কম বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আমানতস্থিতি বেড়েছে .৩৫ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে .০৬ শতাংশ ছিল।

অর্থনীতিবিদ ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক এখন মেয়াদী আমানতের বিপরীতে ১০-১২ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। এত উচ্চ সুদের পরও মানুষ ব্যাংকমুখী হচ্ছে না, যার কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। প্রত্যাশিত হারে আমানত না বাড়ায় ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকটও কাটছে না। তাদের মতে, আস্থাহীনতার কারণেই মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছেন।

সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী জানান, বেসরকারি কিছু ব্যাংকের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে মানুষ সরকারি ব্যাংকে আমানত রাখতে আসছেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, "শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকসহ বেসরকারি কিছু ব্যাংকের বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে মানুষ আতঙ্কিত। ওই ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা আমানত তুলে নিচ্ছেন। তবে সোনালীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা পুরোপুরি না ফেরা পর্যন্ত আমানত প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়বে না।"

মুসলিম চৌধুরী আরও মনে করেন, আমানতের পাশাপাশি বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগও বাড়ানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশী বিনিয়োগ আনার জন্য নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ধরনের পরিস্থিতিতে বিদেশী বিনিয়োগকারী তো দূরের কথা স্থানীয় উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগ করেন না। এটি বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা নয়, বরং এটি বাস্তবতা। ব্যাংক খাত সংস্কারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করছি, এর সুফল দেশের মানুষ অর্থনীতি পাবে।"

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুনের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে এসে আমানতের স্থিতি বেড়ে ১৮ লাখ ১৮ হাজার ৬১১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। সে হিসাবে নয় মাসে আমানত বেড়েছে ৭৫ হাজার ৮১৪ কোটি টাকার, যেখানে আমানত বৃদ্ধির হার .৩৫ শতাংশ।

ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে কয়েক বছর ধরেই মানুষের মধ্যে নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। নগদ টাকার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ইস্যুকৃত নোট (কারেন্সি ইন সার্কুলেশন) বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৩ সালের জুনে ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ ছিল লাখ ১১ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে এসে নোটের পরিমাণ লাখ ২০ হাজার ৩০৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। আর চলতি বছরের মার্চে ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ ছিল লাখ ২১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ইস্যুকৃত নোটের মধ্যে লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকাই ছিল ব্যাংক খাতের বাইরে। অর্থনীতির আকারের তুলনায় নগদ অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, "কিছু ব্যাংকের নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক বছর ধরেই আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ওই ব্যাংকের গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী শাখা কিংবা এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে পারেননি। কারণে মানুষের মধ্যে নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতা বেড়ে গেছে। অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রভাব বেড়ে যাওয়ার কারণেও কিছু মানুষ ব্যাংকবিমুখ হচ্ছে। ঘুস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নগদ লেনদেনে শর্তারোপ করা গেলে অর্থনীতি উপকৃত হতো।"

দেশের ব্যাংক আমানতের ৮৫ শতাংশই নগরকেন্দ্রিক। শহরাঞ্চলে স্থাপন করা ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মুহূর্তে শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামের আমানত প্রবৃদ্ধি ভালো। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চে শহরাঞ্চলে আমানতের প্রবৃদ্ধি .৯৪ শতাংশ হলেও গ্রামাঞ্চলে প্রবৃদ্ধি হয়েছে .০৫ শতাংশ। সময়ে দেশের প্রায় সব শ্রেণীর ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধির ধারায় থাকলেও কেবল ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর আমানত কমে গেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ধারার ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। অথচ রেমিট্যান্স প্রবাহের বৃহৎ অংশই এক সময় ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে দেশে আসত।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান তথা গত বছরের আগস্ট থেকেই দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় প্রবৃদ্ধি চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ২৭.৫১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১.৩৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে প্রবাসীরা .১৪ বিলিয়ন ডলার বেশি পাঠিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৮. শতাংশ।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে আসা রেমিট্যান্সের প্রায় ৭০ শতাংশই প্রবাসী পরিবারের ভোগে ব্যয় হয়। বাকি ৩০ শতাংশ ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা থাকে। তবে গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতের অস্থিরতা উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে প্রবাসী পরিবারের সঞ্চয়েও ভাটা পড়েছে। ব্যাংকে টাকা রাখার পরিবর্তে মানুষ জমি ক্রয় ভোগে বেশি ব্যয় করছেন।

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য