জাঙ্ক ফি: লুকানো চার্জে' দিশেহারা যাত্রীরা

একসময় বিমানের টিকিট মানেই ছিল যাত্রী, লাগেজ, আর খাবারের মতো সবকিছুর একটি সমন্বিত প্যাকেজ। কিন্তু এখন সেই ধারণা বদলে গেছে। বর্তমানে টিকিটের দামে কেবল আপনার আসনের খরচ ধরা হয়। বাড়তি লাগেজ, উড়োজাহাজে খাবার খাওয়া, বা পছন্দসই আসন বেছে নেওয়ার জন্য দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। এই 'জাঙ্ক ফি' (Junk Fee) এখন বৈশ্বিক উড়ান শিল্পে এক বিশাল আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে, যা যাত্রীদের জন্য এক নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

বিমান সংস্থাগুলোর জন্য এখন লাগেজ পরিবহন থেকে আয় হচ্ছে ১৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২০২৪ সালে চেক-ইন ব্যাগের মাধ্যমে ৭.২৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ২৬% বেশি।

এই অতিরিক্ত চার্জের সূচনা হয় ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যের বাজেট এয়ারলাইন্স Flybe-এর হাত ধরে। এরপর এটি দ্রুত ইউরোপের বাজেট ক্যারিয়ারগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, এবং পরবর্তীতে বড় বিমান সংস্থাগুলোও একই পথে হাঁটতে শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্রের এভিয়েশন কনসালটেন্ট জে সোরেনসেন বলেন, "বাজেট এয়ারলাইন্সগুলো বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করায় বড় এয়ারলাইন্সগুলোও লাগেজ ফি চালু করতে বাধ্য হয়েছে।" বর্তমানে বেশিরভাগ বিমান সংস্থা মূল ভাড়াকে কম দেখিয়ে, পরে ব্যাগেজ, আসন নির্বাচন, খাবার ইত্যাদির মাধ্যমে 'লুকানো আয়' বাড়াচ্ছে।

এই অতিরিক্ত ফি এড়াতে যাত্রীরা এখন নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। কেউ ছোট হ্যান্ড ব্যাগে প্রয়োজনীয় সব জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছেন, আবার কেউ ইউটিউব ও টিকটকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা 'লাগেজ হ্যাক' অনুসরণ করছেন। ইউকে-ভিত্তিক লাগেজ কোম্পানি Antler জানিয়েছে, বিমান সংস্থার মাপ অনুযায়ী তৈরি ছোট স্যুটকেসের চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়েছে।

তবে এই সমস্যা এখানেই শেষ নয়। ইউরোপের অনেক বিমান সংস্থা এখন হ্যান্ড লাগেজের জন্যও ফি নিচ্ছে, যা যাত্রীদের ভোগান্তি আরও বাড়াচ্ছে।

কানাডার টরন্টো বিমানবন্দরে যাত্রী লরেন আলেকজান্ডার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "টিকিটের দাম দেখে সাশ্রয়ী মনে হয়, কিন্তু ব্যাগের জন্য ২০০ ডলার দিতে হচ্ছে—এটা আসলে প্রতারণা।" একইভাবে ২৭ বছর বয়সী সেজ রাইলি মন্তব্য করেন, "ভ্রমণ এখন আর আগের মতো সহজ ও সস্তা নেই।"

এই অতিরিক্ত ব্যয় যাত্রীদের মধ্যে যেমন অসন্তোষ তৈরি করছে, তেমনি এটি একটি নতুন ভোক্তাবাজারও তৈরি করেছে। এখন বাজারে হ্যান্ড ব্যাগ, ভ্যাকুয়াম প্যাকিং সরঞ্জাম, লাগেজ হ্যাক গাইড এবং স্মার্ট লাগেজের মতো পণ্যগুলোর চাহিদা বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যতক্ষণ না সরকারগুলো বিমান সংস্থাগুলোকে 'স্বচ্ছ' ভাড়া প্রদর্শনে বাধ্য করে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই 'জাঙ্ক ফি'র বোঝা থেকে যাত্রীরা মুক্তি পাবেন না। এই লুকানো চার্জগুলো যাত্রীদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াচ্ছে এবং ভ্রমণের সামগ্রিক অভিজ্ঞতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে কীভাবে বিকশিত হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।