আতর হলো ভেষজ উৎস থেকে উৎপাদিত সুগন্ধি বিশেষ। আতর শব্দটি পার্শিয়ান শব্দ "ইতির" থেকে এসেছে,যার অর্থ হলো সুগন্ধি। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে আতর হল মুসলমানদের ব্যবহৃত সুগন্ধি দ্রব্য। কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা নামাজে যাওয়ার আগে আতর ব্যবহার করা হয়। মুসলিম পুরুষদের জন্য একমাত্র হালাল সুগন্ধি হলো অ্যালকোহল মুক্ত আতর (যদিও বর্তমানে কিছুটা ভিন্ন মত রয়েছে)। প্রাচীন মিশরীয়রা আতর তৈরিতে প্রসিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে মুসলিম গবেষক আল শেখ আল-রইস নানা রকম সুগন্ধি তৈরীর প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে ভারতেও বিভিন্ন ধরনের উন্নত মানের আতর তৈরি হয়। বর্তমানে আধুনিক সময়ে আতরের অসংখ্য ব্র্যান্ডের মধ্যে মেশক-আম্বর হল সবচেয়ে দামী এবং অভিজাত ব্রান্ড।
মেশক-আম্বর নামে দুটি অতিপরিচিত ও বিখ্যাত খুশবোর কথা আমরা হরহামেশাই শুনে থাকি। মেশক সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানি কিন্তু আম্বর সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা সচরাচর মানুষের কাছে পাওয়া যায়না। অতি দুর্লভ এই জিনিসটি বিত্তবানদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও সাধারণের কাছে এটা তেমন পরিচিত নয়।
মেশক, কস্তুরী বা মৃগনাভি
কস্তুরী সাধারণত এক ধরনের বিশেষ পুরুষ হরিণের পেটে অবস্থিত সুগন্ধি গ্রন্থি নিঃসৃত সুগন্ধির নাম। মিলন ঋতুতে ঐ বিশেষ হরিণের পেটের কাছের কস্তুরী গ্রন্থি থেকে সুগন্ধ বের হয়, যা মেয়ে হরিণকে আকৃষ্ট করে। মিলন ঋতুর পরে তা হরিণের দেহ থেকে খসে পড়ে যায়। তা সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে কস্তুরী তৈরি করা হয়। আবার অনেক সময় কস্তুরী হরিণকে হত্যা করেও মৃগনাভি সংগ্রহ করা হয়। হরিণের বয়স ১০ বৎসর পূর্ণ হলে নাভির গ্রন্থি পরিপক্ক হয়। একটি পূর্নাঙ্গ কস্তুরী গ্রন্থির ওজন ৬০-৬৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। যা মহামূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে পরিচিত। মেশক,কস্তুরি ও মৃগনাভি একই বস্তু।
হিমালয় পর্বতমালার উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে উৎকৃষ্ট কস্তুরী হরিণ পাওয়া যায়, এই হরিণ ছাগলের চেয়ে খুব বেশী বড় নয় কিন্তু দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। এদের পা অত্যন্ত সরু, অপূর্ব মাথা এবং চোখ চমৎকরণ উজ্জ্বল হয়ে থাকে। অতি শীতল পার্বত্য পরিবেশে বাস করায় এদের লোম অন্য হরিণের মত সরু না-হয়ে মোটা এবং পালকের মত হয়ে থাকে। এছাড়া পামির মালভূমির গ্রন্থি পর্বতমালার তৃণভূমি সমৃদ্ধ এলাকায় এই হরিণ পাওয়া যায়।
সুগন্ধি ফুলের মতো যোগ যোগ ধরে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে কস্তুরী মৃগ। এই মৃগ অর্থাৎ হরিণ এক প্রজাতির পুরুষ হরিণ। ইংরেজি নাম মাস্ক ডিয়ার। (Musk Deer) এরা খুব লাজুক স্বভাবের, তাই নিরিবিলি বাস করে, বিচরণ করে একান্ত নির্জনে। কস্তুরী মৃগের উপরের মাড়ি থেকে গজদন্তের (হাতির দাঁত) মত দুটি দাঁত ছোট আকারে বের হয়। এই ধরনের দাঁত সব প্রজাতির হরিণের মধ্যে দেখা যায় না, এটা দেখেই কস্তুরী হরিণ শনাক্ত করা হয়।
কস্তুরী মৃগ আত্মরক্ষায় খুবই পটু কিন্তু এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে না, কারণ এদের দেহের তীব্র ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ অনুসরণ করে শিকারী অতিসহজেই তাদেরকে খুঁজে পেয়ে যায়। মজার ব্যাপার হল, যে হরিণটির নাভিতে এই সুগন্ধি কোষের জন্ম সে নিজে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেনা। তার নাকে যখন এই সুগন্ধ এসে লাগে তখন সে পাগলের মতো এই সুঘ্রাণের উৎসের সন্ধানে ছুটতে থাকে। অথচ সে বুঝতে পারে না যে, এই সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে তার নিজের দেহ থেকেই।
কস্তুরী যখন সংগ্রহ করা হয় তখন এর গন্ধ এত তীব্র থাকে যে হরিণের নাভি কোষ কেটে নেওয়ার সময় শিকারিরা তাদের নাক মুখ মোটা কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখে। অনেক সময়ে এই গন্ধ সহ্য করা কঠিন হয়ে যায়, নাক চোখ দিয়ে পানি এবং মুখ থেকে লালা ঝরা শুরু হয় এবং অনেকক্ষেত্রে জীবন হানিও ঘটে। কথিত আছে কস্তুরির এক বিন্দু পরিমাণ কোন বাড়িতে রেখে দিলে তার সুঘ্রাণ বহু বছর পর্যন্ত সেখান থেকে যায়। তিন হাজার ভাগ নির্গন্ধ (তৈল জাতীয়) পদার্থের সঙ্গে একভাগ কস্তুরী মিশালে সমস্ত পদার্থই সুবাসিত হয় কস্তরীর ঘ্রাণে।
আম্বর
শুনতে অবাক লাগলেও "আম্বর" তৈরি হয় "Sperm Whale" নামে এক ধরনের তিনি মাছের পেটে। মানুষের মত তিমি মাছেরও কুষ্ট কাঠিন্য হয়। অনেক সময় তিমির পেটে খাবার জমাট বেঁধে পাথরের ন্যায় শুষ্ক ও শক্ত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তিনি সহ্য করতে না পেরে মারা যায়। পচে গিয়ে তিমির দেহ সমুদ্রের পানিতে মিশে গেলেও, জমাটবাঁধা খাবার পিণ্ড মোমের ন্যায় সমুদ্রের পানিতে ভাসতে থাকে। দীর্ঘদিনের সূর্যের আলোর সংস্পর্শে মৃত তিমির খাবার পিণ্ডে ফটোডিগ্রেডেশন এবং অক্সিডেশন বিক্রিয়ার ফলে তীব্র ঘ্রাণ বের হতে থাকে। আম্বরের ঘ্রাণে মানুষ চরম পুলকিত হয়, দেহ মন সতেজ ও তাজা হয়ে ওঠে। একটুকরো আম্বর ঘরে রেখে দিলে এটা থেকেও মেশকের এর মত সারাজীবন সুগন্ধ পাওয়া যায়।
গায়ে মাখানো আতরের তেল শুকিয়ে গেলে এর গন্ধ ধীরেধীরে হারিয়ে যায় কিন্তু আম্বরের চরিত্র এমন নয়। এর ঘ্রাণ আম্বর চূর্ণ যতদিন অবিকৃত থাকবে ততদিন পর্যন্ত সুগন্ধ ছড়াতে থাকবে। এইজন্যই আম্বর খন্ডের দাম অমূল্য রতনের মত। ব্যবসায়ীরা আম্বর চুর্ণকে পিষে তরলে মিশিয়ে আতর বানায়।
সঙ্গত কারনেই যে সমস্ত সমুদ্রে "Sperm Whale" এর বিচরণ বেশি, তার আশেপাশেই আম্বর পাওয়া যায়। সে হিসাবে স্পেন, লিথুনিয়া, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, মেক্সিকো, আমেরিকা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, নিকারাগুয়া ও কলম্বিয়ার মতো দেশগুলোতে আম্বর পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে অরিজিনাল মেশক-আম্বর পাওয়া যায় কিনা বা মূল্য কত তার কোন তথ্য জানা নাই। তবে দুবাই এক্সপো ২০২০ এ লিথুনিয়ার প্যাভিলিয়নে আম্বরের খাটি আতরের প্রদর্শনী দেখা গেছে। সাত মিলি আতরের দাম বাংলাদেশের টাকায় আট হাজার টাকারও বেশি ছিল।
সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে উন্নত রুচিবোধ, ব্যক্তিত্ব মানুষকে সবার কাছে সেরা করে তোলে। তাইতো সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ আজন্ম। নিজেকে শালীন, পরিপাটি, সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করেন যেকোনও রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ। দেহ-মন ফুরফুরে রাখতে সুগন্ধি-আতর ব্যবহার করে থাকেন। সুগন্ধির ব্যবহার অনেকটা মানুষের আভিজাত্যকেও ফুটিয়ে তোলে।
সুগন্ধি আতর ব্যবহার পছন্দ করতেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মেশক-আম্বর ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পছন্দের আতর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যেমন সুগন্ধি আতর ব্যবহার করতেন, তেমনি অন্যদেরকে সাধ্যমত ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে লোকসমাগমে গেলে, জুমার দিনে, ঈদের দিনে সুগন্ধি ব্যবহারের বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন। তিনি নিজেও ঈদের জামাতে যাওয়ার আগে পছন্দের সুগন্ধি ব্যবহার করেছেন।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?