clock ,

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে ডিবির চার্জশিট: প্রতারণা, মানব পাচার ও নির্যাতনের ভয়ংকর চিত্র

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে ডিবির চার্জশিট: প্রতারণা, মানব পাচার ও নির্যাতনের ভয়ংকর চিত্র

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিতচাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’-এর চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টা, জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া মৃত্যু সনদ তৈরির পাশাপাশি মানব পাচারের অভিযোগে করা মামলার তদন্ত শেষ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে উঠে এসেছে তার বিরুদ্ধে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

গত বছরের মে দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিতমানবিক মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর মিল্টন সমাদ্দারশিরোনামের প্রতিবেদনে উত্থাপিত অনেক অভিযোগের সত্যতা মিলেছে ডিবির তদন্তে।

ডিবির চার্জশিট অনুযায়ী, ডাক্তার না হয়েও নিজেই অস্ত্রোপচার করতেন মিল্টন। তিনি আশ্রমে থাকা অসুস্থদের ক্ষতস্থানে ছুরি বা ব্লেড দিয়ে কেটে দিতেন এবং প্রয়োজনে হাত-পা কেটে ফেলতেন। ফেসবুকে ৯০০ জনের লাশ দাফনের দাবি করলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০। এছাড়া, তিনি নিজে স্বাক্ষর দিয়ে ভুয়া মৃত্যু সনদ তৈরি করতেন এবং এসব কার্যক্রম থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করতেন।

তার ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে কোটি ৮০ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৩ টাকা। ফেসবুকে তার কোটি ৬০ লাখের বেশি অনুসারী রয়েছে, যাদের সহানুভূতি কাজে লাগিয়ে তিনি বিপুল পরিমাণ অনুদান সংগ্রহ করতেন। তবে, আশ্রমের অসহায় মানুষের কল্যাণে এই অর্থ খরচ না করে ব্যক্তিগত সম্পদ গঠনে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তদন্তে জানা গেছে, বরিশালের উজিরপুর থানার ডহরপাড়া গ্রামের সামাদিয়া দারুল উলুম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মিল্টন। সপ্তম শ্রেণিতে প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর জাল করে সনদ তৈরির অপরাধে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

এছাড়া, এলাকায় এক ব্যক্তিকে মারধর করার পর তার বাবা তাকে শাসন করতে গেলে মিল্টন মাছ ধরার টেঁটা দিয়ে বাবাকে আঘাত করেন। পরে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে যান এবং সেখানে ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। পরে নার্সিং প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেন এবং ২০১৬ সালেচাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার সেন্টারপ্রতিষ্ঠা করেন।

২০১৭ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন নিলেও কোনো পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেননি মিল্টন। ২০১৯ সালে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সহকারী সচিব মো. তরিকুল ইসলামের স্বাক্ষর জাল করেচন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চ’-এর কমিটিতে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন, যা পরবর্তীতে ধরা পড়ে।

ডিবির চার্জশিটে বলা হয়েছে, রাস্তা থেকে অসুস্থ প্রতিবন্ধীদের তুলে এনে তাদের নিজের আশ্রমে রাখতেন মিল্টন। এরপর নিজের তৈরিঅপারেশন থিয়েটারেনিয়ে তাদের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতেন এবং প্রয়োজন হলে নিজেই অপারেশন করতেন।

ফেসবুকে মানবিক মুখোশ ধারণ করলেও বাস্তবে তার আশ্রমে থাকা বৃদ্ধ প্রতিবন্ধীদের ওপর চলত শারীরিক নির্যাতন। যারা অস্বাভাবিক আচরণ করত, তাদের মারধর করা হতো। অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করে শরীরে ক্ষত তৈরি করা হতো, যা পরে মিল্টন নিজেই চিকিৎসার নামে সেলাই করতেন।

মিল্টন তার সহযোগীরা ফেসবুকে অসুস্থ, প্রতিবন্ধী বৃদ্ধদের ছবি ভিডিও প্রকাশ করে সহানুভূতি অর্জনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতেন। আশ্রমের মানুষের জন্য অনুদান তোলার নামে টাকা নিলেও সেই অর্থ ব্যবহার করা হতো ব্যক্তিগত স্বার্থে।

তিনি দাবি করেন, ৯০০টি লাশ দাফন করেছেন, কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল মাত্র ১৫০টি। বেশি লাশ দাফনের কথা বলে বেশি অর্থ সংগ্রহ করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

মিরপুর মডেল থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, তদন্ত শেষে দুটি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে, যা আগামী ২০ মার্চ উপস্থাপন করা হবে।

ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আতাউর রহমান জানান, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগেরও সত্যতা মিলেছে। মাত্র ২০ হাজার টাকায় তিনি দুই বছরের একটি শিশুকে নিঃসন্তান এক দম্পতির কাছে বিক্রি করে দেন।

মিল্টন সমাদ্দারের আইনজীবী ওহিদুজ্জামান বলেছেন, “এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, আমরা চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। আমার মক্কেল নির্দোষ, এবং আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় তা প্রমাণ করব।তবে তদন্তে ওঠে আসা তথ্য চার্জশিটের ভিত্তিতে এটি একটি গুরুতর অপরাধের মামলা, যা আদালতের চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য