clock ,

বাংলা-ভারত, চীন-মার্কিন মঙ্গলযাত্রা!

বাংলা-ভারত, চীন-মার্কিন মঙ্গলযাত্রা!

বাংলাদেশকে বিনিয়োগের একটি হাব বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে . ইউনূসের বিশ্ব ইমেজ ঘিরে। বিনিয়োগ সম্মেলন প্রশ্নে এবারের আবহটা ছিল ভিন্ন। বড় মোক্ষম প্রাসঙ্গিক সময়ে বাংলাদেশের কোর্টে নিয়ে আসা হয় বিনিয়োগের বলটি। যখন যাবতীয় আলোচনা-পর্যালোচনার মূলে প্রধান উপদেষ্টা . ইউনূসের সফরে চীন কী দিয়েছে, আরও কত কী দেবে বাংলাদেশকে প্রশ্ন নিয়ে; সেই আলোচনায় ছেদ ফেলে বিমসটেক সম্মেলন, সেখানে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা . মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক। সেখানে আবার ছেদ-ছন্দপতন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কারারোপের ঘটনা। সেটা কাটতে না কাটতেই ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল।

এসবে সবাই জিতছেন, ঠকছেন না কেউ। এগোচ্ছেন মঙ্গলযাত্রায়। ভারত একতরফাভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করে বাংলাদেশকে ফাঁপরে ফেলে জিতেছে। প্রমাণ করেছে চুক্তি-সমঝোতা এগুলো কিছুই না। চাইলেই বাতিল করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বিজয়ী। কিছুদিনের জন্য স্থগিতাদেশ দিয়ে বিজয়ী করেছেন অনেককে। চীন পাল্টা শুল্ক অ্যাকশনে গিয়েও হিম্মতবান। বাংলাদেশ তাক লাগিয়েছে বিনিয়োগ সম্মেলন করে। হালহকিকতে কেউই হাল ছাড়ছে না।

নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার জয়গাথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, বিশ্বনেতারা এখন আমাকেস্যার’ ‘স্যারকরছেন। তাকে কত আবেদন-নিবেদন করছেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খাতির জমাতে। ৭৫টির বেশি দেশের প্রতিনিধি ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেসমঝোতাকরতে কল করেছেন। সমঝোতার সুযোগ তৈরি করতে ট্যারিফ ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সময়ে এই দেশগুলোর ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ ট্যারিফ কার্যকর থাকবে। বাংলাদেশের জন্য রিসিপ্রোকাল ট্যাক্স ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ এনেছেন। এখন ১৫+১০ = ২৫ শতাংশ শুল্কে আমাদের পণ্য আমেরিকায় ঢুকতে পারবে। অন্যরকম ব্যাপার-স্যাপার।

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের জন্য ভারতীয় স্থলবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পাঠানোর ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে ভারত অঞ্চলে তার সক্ষমতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের কারও কারও মধ্যে নিয়ে ভয় থাকলেও কাও কারও মতে, এতে বাংলাদেশের কিছুই হবে না। বিকল্প সক্ষমতা বাড়বে। এর মধ্যে আবার বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল কামনা করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। বলেছেন, ভারতের মতো অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশের এতটা মঙ্গল চায় না। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, নয়াদিল্লি তার প্রতিবেশীর জন্যমঙ্গল কামনা করে

এসব আমলে নিলে চারদিকেই তো সমানে মঙ্গলবার্তা। নিজেরা জিতছে, অন্যকেও জেতাচ্ছে। বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবাসহ নানা বিনিয়োগ নিয়ে চীন এগিয়ে এসেছে। খাদ্যপণ্যের জাহাজ নিয়ে পাকিস্তান এগিয়ে এসেছে। নেপাল-ভুটান বলছে, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে কোনো সমস্যা হবে না। এর মধ্যেই আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেছে। বিনিয়োগের অনেক আশ্বাস মিলেছে। যে সম্মেলন আগে হতো বিদেশে, সেটি এবার হয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। এটি এরকম সময়ে আরেক জয়।

আশার প্রদীপ জ্বালানো চার দিনের সম্মেলনে ২৬ কোটি মার্কিন ডলারের দুটি মোটাদাগের বিনিয়োগ প্রস্তাব মিলেছে। আরও আছে পাইপলাইনে। তাৎক্ষণিক কত বিনিয়োগ পাওয়া গেল, তা সামিটের উদ্দেশ্য ছিল না। বরং একটি ইনভেস্টমেন্ট পাইপলাইন তৈরি করা, মানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে সম্ভাবনা তুলে ধরা, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পরিচয় করে দেওয়া আর একটি বিনিয়োগ পাইপলাইন তৈরি করাই সামিটের উদ্দেশ্য। এবারের সামিটে অংশ নেওয়া প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ১৮ থেকে ২০ মাসের মধ্যে তাদের অনেকে বিনিয়োগ করবে এমন প্রত্যাশা দেখা দিয়েছে। এমন আশাব্যঞ্জক একটি সম্মেলনকালে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে তেমন কিছু যায় আসে না।

বিগত সময়ে বিনিয়োগ সম্মেলন হতো বিদেশে। দেশ থেকে দল বেঁধে ব্যাংকাররা যেতেন, সঙ্গে থাকতেন কিছু ব্যবসায়ী, আমলা বিশেষ কোটারির কিছু সাংবাদিকের লটবহর। সবাই মিলে মৌজমাস্তিতে সরকারি টাকা খরচ করে আসতেন। কেউ কেউ থেকেও যেতেন বা পরে সুবিধামতো সময়ে বিদেশে থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এবার সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগের বলটি বাংলাদেশেই এসেছে। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে সম্ভাব্য বিনিয়োগের আওয়াজ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের কেউ বিনিয়োগ করেছে কি না, সেই তথ্য থাকে না। বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের কাছেও -সংক্রান্ত তথ্য নেই। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিসহ তালিকা তৈরির কাজ চলছে। সে তালিকা অনুযায়ী আগামী ১৮ থেকে ২০ মাসের মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বিনিয়োগ করানো সম্ভব হবে। এটিও বাংলাদেশের জন্য এক জয়সূচক।

প্রধান উপদেষ্টা . ইউনূসের চীন সফরের পর মাত্র কদিন আগে ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে . ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর অপেক্ষা ছিল দুই দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি দেখার। তার ঝলক দেখা গেল বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের মধ্য দিয়ে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, হঠাৎ ভারতের এভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে শেষ পর্যন্ত সমস্যা হবে না। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংকট কাটাতে চেষ্টা করা হবে। ভারতের ভেতর দিয়ে প্রতিবেশী ভুটান, নেপাল মিয়ানমার পণ্য পরিবহনের ট্রান্সশিপমেন্ট হঠাৎ বাতিল করায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংকট কাটাতে চেষ্টা করতেই হবে বাংলাদেশকে। বাড়াতে হবে নিজস্ব বাণিজ্যিক সক্ষমতা। এদিকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ভারতের প্রত্যাহারের ফলে মালদ্বীপের সঙ্গে বাণিজ্যে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত শাউনিন রশিদ। ভারতের এমন সিদ্ধান্তে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্কে তেমন বড় কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তিনি। আরও জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে মালদ্বীপের বাণিজ্য স্বাভাবিক থাকবে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ভিন্ন উচ্চতার সম্পর্কের সমান্তরালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক গভীর করে এনেছেন . ইউনূস। শুল্ক ইস্যুতে তা দেখা গেল একদম নগদে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অধ্যাপক . মুহাম্মদ ইউনূসের চিঠি এবং এতে ট্রাম্পের সাড়া দেওয়ার ঘটনায় তা আরও স্পষ্ট। চিঠিতে তিন মাসের জন্য বাংলাদেশের ওপর আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রস্তাব স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন ইউনূস। আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর মধ্য দিয়ে . ইউনূসের খ্যাতি-জ্যোতি এবং বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আবারও প্রমাণ হলো। এর মাঝে বাড়তি জয় হিসেবে ঢাকায় হয়ে গেল বাণিজ্য সম্মেলনটি। নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগের খবর দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্টার্টআপ কানেক্ট অধিবেশনে দেশি-বিদেশি তরুণ উদ্ভাবনী উদ্যোক্তারা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল মাধ্যমে রেকর্ড করা বক্তব্য দেন লিংকডইনের সহপ্রতিষ্ঠাতা রিড হফম্যান।এম্পাওয়ারিং ইনোভেশন কানেকটিং অপরচুনিটিশিরোনামের বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশ কী পেয়েছে, কী পাবে সেই হালখাতা এখনই মেলানো সম্ভব নয়। সম্মেলনের প্রাপ্তি দৃশ্যমান হবে ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একটা বার্তা পেয়েছেন এরই মধ্যে। আর তাৎক্ষণিক বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড-বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।

তিনি জানিয়েছেন, আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে দেশে ১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগের সমান্তরালে নিয়োগ আরেকটি আকর্ষণীয় শব্দ। ১৫ হাজার কেন, ১৫ লাখ বা ১৫ শতনিয়োগযা শুনবে, তা- মানুষের শুনতে ভালো লাগে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কর্মসংস্থান বিনিয়োগের বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্য করে আশিক চৌধুরী বলেন, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, বিনিয়োগের স্বার্থগুলো অপরিবর্তিত রাখতে চায় বিডা। সে লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দলকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে সরকারের সম্মেলন আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ক্ষমতা পেলে তারা নিয়োগ-বিয়োগে কী ভূমিকা রাখবেন, তা জানান দিয়েছেন। সম্মেলনকালে স্ত্রীর চিকিৎসার্থে দেশের বাইরে থাকা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের -বিষয়ক একটি পোস্ট ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রথম ১৮ মাসে এক কোটি কর্মসংস্থান বা চাকরির ব্যবস্থা করবে বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রথম ১৮ মাসেই এক কোটি লোকের চাকরি মানে পাঁচ বছরে তিন কোটি লোকের চাকরি। প্রতি মাসে গড়ে ৩০ দিন হলে, ১৮×৩০ = ৫৪০ দিন।

তা কীভাবে সম্ভব? ‘ ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমিশিরোনামে দেওয়া তার ওই পোস্টে প্রশ্নের জবাবসহ চমৎকার ব্যাখ্যা রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)/মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রার শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ থেকে জিডিপির দশমিক শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে বিএনপি। ২০৩৪ সালে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ট্রিলিয়ন ডলার ধরেছে দলটি। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইকে জনপ্রিয় করতে বিএনপি ১১টি রেগুলেটরি পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে বলেও পোস্টে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। এর মধ্যে আটটি প্রস্তাবের কথা তুলে ধরেছেন তিনি। এগুলো হলো বিডাকে কার্যকর করা, ভিসা বা ওয়ার্ক পারমিট বিধির আধুনিকীকরণ, বিনিয়োগকারীদের জন্য ২৪× (দিনে ২৪ ঘণ্টা সপ্তাহে দিন) সেবা চালু করা, স্বয়ংক্রিয় মুনাফা প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা, স্থানীয়ভাবে দক্ষ জনশক্তির ব্যবস্থা করা, বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবসম্পদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রকৃত প্রশিক্ষণ প্রণোদনার ব্যবস্থা করে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের পরিমাণ আওতা বৃদ্ধি। মির্জা ফখরুলের পোস্টটি এক কথায় চমৎকার। বাকিটা নির্ভর করবে বাস্তবায়নে। আর সরকারি-বেসরকারি যে কোনো নিয়োগের আগে দরকার বিনিয়োগ। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সম্মেলনসহ পারিপার্শ্বিকতা অবশ্যই জয়সূচক।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

সম্পর্কিত খবর

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য