বাংলাদেশের মাগুরায় শিশু ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে যত ভাবছি, ততই হতবাক হচ্ছি। আবার একটি পরিবারের পুত্রবধূকে ধর্ষণ করতে চায় তার শ্বশুর হিটু মিয়া। সে পুত্রবধূদের যৌন হয়রানি করে। সে জন্য পুত্রবধূরা তালাক দিয়ে চলে যায়। এর পরে পুত্র সজীব আবার একটি বিয়ে করে আনে। সেই বউকেও হয়রানি করে হিটু। এ কথা সজীবকে জানালে সে উল্টো স্ত্রীকেই মারধর করে। এরপর মেয়েটি তার মাকে জানায়। মা মেয়েকে বিশ্বাস করলেও আবার সেই ধর্ষকদের বাড়িতেই মেয়ে পাঠায়। কেন? কারণ ঘর ভেঙে যাবে। এমন ঘর ভাঙলেই কি আর থাকলেই কি। মেয়ে যেন ভয় না পায় সেজন্য আবার ৮ বছরের ছোট মেয়েকে পাঠানো হয় সেই ধর্ষকের বাড়িতেই। এবার সজীবই রাতের অন্ধকারে তার শ্যালিকা শিশু মেয়েটিকে ধর্ষক বাবার কাছে দিয়ে আসে। আবার ধর্ষণের পর মেয়েটিকে যেন হত্যা করা যায় সে জন্য উদ্যোগী হয় হিটুর বউ। পরে হত্যায় ব্যর্থ হয় তারা। আমি বুঝতে পারছি না, এটা কেমন পারভার্ট পিডোফাইলাক পরিবার। এমন পরিবার বাংলাদেশে আর কতগুলো আছে? আবার আরেকটি খবরে দেখলাম, ৯ বছরের এক মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এগুলো কী চলছে? তবে এসব যে এখন শুরু হয়েছে তা নয়। অনেক বছর ধরেই চলছে। দিনাজপুরে একটি ৬ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। আরও অসংখ্য শিশু ও নারী ধর্ষণের নজির রয়েছে গত কয়েক দশকে। বাংলাদেশে হিটু মিয়ার মতো ধর্ষক ও তার সহযোগী পারভার্ট পরিবার নিশ্চয়ই আরও আছে। এর কারণ হলো, নারী যে বয়সেরই হোক তাকে ধর্ষণ করাকে বাংলাদেশের মানুষ কোনো ক্রাইম বলেই মনে করে না। শালীর সঙ্গে ঠাট্টার নামে যৌন নির্যাতন, হয়রানি ও ধর্ষণের রীতি স্মরণাতীতকাল ধরেই চলছে। শালীকে ‘আধা ঘরওয়ালি’ বলে প্রচারের মাধ্যমে এগুলোকে পরোক্ষ সমর্থন দেওয়া হয়েছে। দেবরের রসিকতার নামে ভাবিকে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনাও কম ঘটেনি বাংলাদেশে।
ধর্ষণ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাবে অহরহ ঘটেছে, ঘটছে। অতীতে সমাজের প্রভাবশালীরা নারী ও শিশুকে নিজেদের খেয়ালখুশিতে ধর্ষণ করেছে, নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে। এখনো সেই ধারা চলছে। ধর্ষণ মূলত পাওয়ার গেম। একজনের ওপর অন্যজনের ক্ষমতা দেখানোর কৌশল। এমনকি পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে বিরোধ কিংবা জমিজমা ও ক্ষমতা নিয়ে বিরোধের জেরেও প্রতিপক্ষ পরিবারের নারী ও শিশুদের ধর্ষণ করা হয়েছে। মাগুরায় শিশুকন্যা ধর্ষণের ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ পড়ে শিউরে উঠেছি। নরপিশাচ ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি। শুধু ধর্ষক নয়, তার সহযোগীদেরও কঠোর শাস্তি দাবি করছি। যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। বাংলাদেশে নারী বিশেষ করে প্রান্তিক অবস্থানের শিশু ও নারীর জীবনের যেন কোনো মূল্যই নেই। পিডোফাইলাকদের হাত থেকে ছেলে-মেয়ে কোনো শিশুই নিরাপদ নয়। তবে মেয়েশিশুরা বেশি অনিরাপদ। আর প্রান্তিক অবস্থানের নারীর তো কোনো বয়সেই নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। ধর্ষণের প্রসঙ্গ উঠলে অনেক বিকৃত মানসিকতার মূর্খ পোশাকের প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে আসে। তাদের প্রশ্ন করি, চার বছরের শিশু পোশাকের কী বোঝে? আর যে নারীরা সাধারণত ধর্ষণের শিকার হয় তারা বেশিরভাগই প্রান্তিক অবস্থানের। তারা তো সালোয়ার কামিজ বা শাড়িই পরে থাকেন। তারা কি বিকিনি পরে চলাচল করেন? হিজাব পরিহিত তনুও তো ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিল। অনেক বোরকা পরিহিত নারীও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আর অসংখ্য নারী ও শিশু ঘরের ভেতর পরিচিত আত্মীয়স্বজন দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাছাড়া একজন নারীকে দেখলেই পুরুষ সংযম হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে সেটাই বা কেমন কথা? ‘সংযম হারানো’, ‘নারীর পোশাক’ ইত্যাদি ফালতু কথা বলে ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করাই অপরাধ বলে গণ্য হওয়া উচিত। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ‘ধর্ষণ’ পোশাক নয় বরং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ঘটছে। আজ পর্যন্ত কতজন ভিকটিম সঠিক বিচার পেয়েছেন? কতজন অপরাধী কঠোর শাস্তি পেয়েছে? যখন একজন অপরাধী বিচারের সম্মুখীন না হয়ে দিব্যি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন আরও দশজন অপরাধীর জন্ম হয়। তারা মনে করে কই কিছুই তো হলো না। তখন তারা ধর্ষণকে একটা বিনোদন হিসেবে দেখে। নারীর ওপর বা প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবার বা দরিদ্রদের ওপর নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে দেখে।
ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়াও ভীষণ জটিল ও দীর্ঘসূত্রতায় আক্রান্ত। ভিকটিমের সঠিক ও দ্রুত ডাক্তারি প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নেই। ভিকটিমকে পরীক্ষার জন্য নারী চিকিৎসকও খুব কম। ফলে পুরুষ চিকিৎসকের কাছে গিয়ে দ্বিতীয়বার ট্রমার মধ্যে পড়ে ভিকটিম। আরও চলে ভিকটিম ব্লেমিং। নারী যেন তার নিজের দোষেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমনটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়। ভিকটিমের সামাজিক মানসম্মানও যেন ধুলায় মিশে গেছে এমনটা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। অবিবাহিত নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হলে তার বিয়ের সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। আবার বিবাহিত নারী ধর্ষণের শিকার হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামী তাকে পরিত্যাগ করে। এ জন্য ধর্ষণের কথা বেমালুম চেপে রাখারও প্রবণতা দেখা যায়। আরেকটি প্রবণতা হলো সামাজিক সালিশ নামক প্রহসনের মাধ্যমে ধর্ষকের সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ে দেওয়ার ভ্রান্ত রীতি। এর মাধ্যমে ধর্ষণকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মনে রাখতে হবে ধর্ষণ একটি মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধ। এক্ষেত্রে কেন ধর্ষকের সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ে দেওয়া হবে? ডাকাতি ও হত্যার মতো ধর্ষণও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশ্বের অনেক দেশেই ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনও যথেষ্ট কঠোর। কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যা হলো কাজীর গরু কেতাবেই রয়েছে, বাস্তবে নেই। যদি প্রতিটি ধর্ষণের জন্য দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তি বাস্তবায়িত হতো তাহলে সম্ভাব্য অপরাধীরা ভয় পেত। তারা এমন অপরাধ করার আগে চিন্তা করত।
কিছুদিন আগেই পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবসের আগেই মাগুরার এ ঘটনাটি প্রমাণ করেছে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন এখনো তলানিতে আছে এবং এখনো নারী কতখানি অনিরাপদ। সমাজে নারীর ভালনারেবল অবস্থান প্রমাণ করছে, জাতি হিসেবে দেশ হিসেবে আমরা কত পিছিয়ে আছি। এ ধরনের ঘটনা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের মাথা নিচু করে দেয়। ধর্ষকের দেশ হিসেবে পরিচিত হয় প্রিয় মাতৃভূমি। বাংলাদেশের দরিদ্র নারী দ্বিমুখী নির্যাতনের শিকার। দরিদ্র হিসেবে এবং নারী হিসেবে তার অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। চীনে নারী দিবস পালিত হয়েছে সাড়ম্বরে। এখানে নারী দিবসে নারীদের ফুল ও অন্যান্য উপহার দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের দিক থেকে চীনে প্রতিটি দিনই নারী দিবস। কারণ এখানে নারীরা দারুণভাবে নিরাপদ। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মহান নেতা মাও সে তুং বলেছিলেন, চীনের অর্ধেক আকাশ ধরে রেখেছে নারী। কথাটি যে কত সঠিক, তা এখানে কিছুদিন থাকলেই বোঝা যায়। হাটবাজারে, অফিসে, কারখানায়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সব জায়গায় নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। পুরুষের সমান দক্ষতা কথাটি বলিনি, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি দক্ষ। নারীরা এরোপ্লেন থেকে শুরু করে বাস, ট্রেন, গাড়ি সবই চালাচ্ছেন। নারীদের ছোট বড় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলছে। চীনের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে অনেকেই নারী। নিজের উদ্যোগে তারা এই সম্পদ অর্জন করেছেন।
এখানে জানিয়ে রাখছি, কর্মক্ষেত্রে নারীরা সবাই পাশ্চাত্য রীতির পোশাক পরে। মুসলিম চীনা নারীরা অনেকে মাথায় একটা স্কার্ফ পরে। এছাড়া শার্ট-প্যান্ট, স্কার্ট, গাউন সব রকম পোশাকেই সবাইকে দেখা যায়। মিনি স্কার্ট পরা তরুণীও প্রচুর। কেউ তাদের হেনস্তা করছে না। চীনে আমি কখনো কোনোদিন কাউকে ইভটিজিং করতে দেখিনি। যদি কেউ কোনো নারীকে হয়রানি করে, তাহলে কড়া শাস্তি পায়। আর সহিংসতা বা নির্যাতনের তো প্রশ্নই ওঠে না। যদি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বা এ ধরনের কোনো অপরাধ ঘটে তাহলে দ্রুতই বিচার করা হয়। এবং কঠিন শাস্তি মেলে। চীনে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো আইনগত বৈষম্য নেই। মাতৃকালীন দীর্ঘ সবেতন ছুটি, প্রমোশন, শিশুযত্ন কেন্দ্র সবকিছুরই ব্যবস্থা আছে। ফলে নারীরা তাদের পূর্ণ শক্তিকে কাজে লাগাতে পারেন। চীনের আজকের অভাবনীয় উন্নতির পেছনে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমি চীনে একা থাকি। কখনো নিজেকে অনিরাপদ বলে মনে হয় না। এটা যে কত বড় স্বস্তির সেটা মর্মে মর্মে অনুভব করি। আহা, বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশ যদি নারীর জন্য এমনি নিরাপদ হতো। বাংলাদেশে যতদিন না নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, ততদিন কোনো রকম উন্নয়নই সম্ভব হবে না। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। এই অর্ধেক জনগোষ্ঠী যদি প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, যদি সবসময় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকতে হয় তাহলে কীভাবে তারা দেশের জন্য, পরিবারের জন্য অবদান রাখবে?
বাংলাদেশে কোথায় নারী নিরাপদ? কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কল-কারখানায়, হাসপাতালে, বাসে, পথেঘাটে, পরিবারের ভেতরে সব জায়গায় নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিক্ষক, সহকর্মী, সহপাঠী, ডাক্তার এমনকি নিতান্ত আপনজনরাও তাকে ধর্ষণ করছে। আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে জেনেছি নারী পারিবারিক সদস্যদের দ্বারাও কতভাবে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়। বাংলাদেশকে যদি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলতে হয় তাহলে অবিলম্বে দেশকে ধর্ষকমুক্ত করতে হবে। সরকারের কাছে প্রতিটি ধর্ষণের কঠোর বিচার দাবি করছি। যেন দ্রুত বিচারের আওতায় এনে ধর্ষক ও তার সহযোগীদের কঠিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়।
লেখক: সাহিত্যিক, শিক্ষক ইউননান বিশ্ববিদ্যালয়, চীন
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?