সদ্য আত্মপ্রকাশ করা দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর অভিযোগ, ‘ক্যান্টনমেন্ট থেকে’ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা চলছে। তার এ বক্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
বিএনপির অবস্থান
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী শুক্রবার (২১ মার্চ) ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, “যারা গণহত্যা ও লুটপাটে জড়িত নন, তাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ থাকতে পারে।” তার বক্তব্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বিকল্প নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ফিরলে বিএনপির আপত্তি থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছে, বিচার নিয়ে নয়। গণহত্যায় জড়িতদের বিচার নিশ্চিতের পর আওয়ামী লীগ যদি জনগণের কাছে ক্ষমা চায়, এবং জনগণ তা মেনে নেয়, তাহলে আমাদের আপত্তি নেই।”
জামায়াতের কঠোর প্রতিক্রিয়া
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে বলেন, “আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন জনগণ মেনে নেবে না। ৩৬ জুলাইয়ের আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অধ্যায় চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই মুহূর্তে জনগণ কেবল গণহত্যার বিচার চায়। অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই।”
হাসনাত আব্দুল্লাহর অভিযোগ ও এনসিপির অবস্থান
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) মধ্যরাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে একটি পোস্ট দিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ দাবি করেন, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, যেন আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রস্তাব মেনে নেওয়া হয়। তিনি এই পরিকল্পনাকে “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ” নামে নতুন ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “হাসনাত আব্দুল্লাহর অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত হলেও দাবি দলীয় পর্যায়ের। আমরা শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছি।”
তিনি আরও বলেন, “গতকাল হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না করার পক্ষে আলোচনা জোরালো হতে থাকায় হাসনাত আব্দুল্লাহ তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে তার বক্তব্য দলের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
আইএসপিআরের প্রতিক্রিয়া
এই অভিযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, “হাসনাত আব্দুল্লাহর স্ট্যাটাসের বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।”
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিবিসিকে বলেন, “আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।”
সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন চৌধুরী ও শেখ ফজলে নূর তাপসকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরতে পারে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা-ই থাকবেন।
হাসনাতের ফেসবুক পোস্ট
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর একটি ফেসবুক পোস্ট নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। বৃহস্পতিবার রাতে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি পোস্টটি করেন।
তার পোস্টটি হুবুহু তুলে ধরা হলো-
'১১ই মার্চ,সময় দুপুর ২:৩০।
কিছুদিন আগে আমি আপনাদের বলেছিলাম যে, 'রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ' নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরিন শারমিন, তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।
আমি সহ আরও দুইজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় ১১ই মার্চ দুপুর ২:৩০এ। আমাদেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদেরকে বলা হয়- ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে - তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা না-কি ভালো। ফলশ্রুতিতে আপনি দেখবেন গত দুইদিন মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের পক্ষে একাধিক রাজনীতিবিদ বয়ান দেওয়া শুরু করেছে।
আমাদেরকে আরো বলা হয়-রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।
আমাদেরকে এই প্রস্তাব দেওয়া হলে আমরা তৎক্ষণাৎ এর বিরোধিতা করি এবং জানাই যে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে কাজ করুন।
এর উত্তরে আমাদের বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ফিরতে কোন ধরণের বাধা দিলে দেশে যে সংকট সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে এবং 'আওয়ামী লীগ মাস্ট কাম ব্যাক'।
আলোচনার এক পর্যায় বলি-যেই দল এখনো ক্ষমা চায় নাই, অপরাধ স্বীকার করে নাই, সেই দলকে আপনারা কিভাবে ক্ষমা করে দিবেন! অপরপক্ষ থেকে রেগে গিয়ে উত্তর আসে,' ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডোম এন্ড এক্সপিরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর এটলিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স।তোমার বয়সের থেকে বেশি। তাছাড়া আওয়ামী লীগ ছাড়া 'ইনক্লুসিভ' ইলেকশন হবে না।'
উত্তরে বলি, 'আওয়ামী লীগের সাথে কোন ইনক্লুসিভিটি হতে পারে না।আওয়ামী লীগকে ফেরাতে হলে আমাদের লাশের উপর দিয়ে ফেরাতে হবে। আওয়ামী লীগ ফেরানোর চেষ্টা করা হলে যে সংকট তৈরি হবে, তার দায়ভার আপনাদের নিতে হবে'।
পরে- মিটিং অসমাপ্ত রেখেই আমাদের চলে আসতে হয়।
জুলাই আন্দোলনের সময়ও আমাদের দিয়ে অনেককিছু করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো এজেন্সি কখনো বা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নানা ধরণের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করতে চাপ দেয়া হয়েছে। আমরা ওসব চাপে নতি স্বীকার না করে আপনাদের তথা জনগণের উপরেই আস্থা রেখেছি। আপনাদের সাথে নিয়েই হাসিনার চূড়ান্ত পতন ঘটিয়েছি।
আজকেও ক্যান্টনমেন্টের চাপকে অস্বীকার করে আমি আবারও আপনাদের উপরেই ভরসা রাখতে চাই। এ পোস্ট দেওয়ার পর আমার কী হবে আমি জানি না। নানামুখী প্রেশারে আমাকে হয়তো পড়তে হবে হয়তো বিপদেও পড়তে হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে কোন ধরণের আপোষ করার সুযোগ নাই।
জুলাইয়ের দিনগুলোতে জনগণের স্রোতে ক্যান্টনমেন্ট আর এজেন্সির সকল প্রেসক্রিপশন আমরা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আজ আবারও যদি আপনাদের সমর্থন পাই, রাজপথে আপনাদের পাশে পাই তবে আবারও এই আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের ভারতীয় ষড়যন্ত্রও আমরা উড়িয়ে দিতে পারবো।
আসুন, সকল যদি কিন্তু পাশে রেখে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারলে জুলাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমাদের শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত আমাদের শহীদদের রক্ত আমরা বৃথা হতে দিবো না। ৫ আগস্টের পরের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কামব্যাকের আর কোন সুযোগ নাই বরং আওয়ামী লীগকে অবশ্যই নিষিদ্ধ হতেই হবে'।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?