পাঁচ ভাই—বোনের মধ্যে রাসেল ছিল সবার বড়। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে পরিবারের শেষ সম্বল পৈতৃক ভিটা বিক্রি করে ও স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মোট ১৫ লাখ টাকা দিয়ে একই গ্রামের দালাল লিলু মিয়ার মাধ্যমে তিনি লিবিয়ায় যান। লিবিয়ায় পেঁৗছানোর পর তাকে স্থানীয় দালাল চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় নির্যাতন। দালাল চক্র রাসেলকে নির্যাতনের ভিডিও বাংলাদেশে পাঠিয়ে পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন দফায় আরও ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। সর্বশেষ আরও ১০ লাখ টাকা দাবি করে চক্রটি। কাঁদতে কাঁদতে রাসেলের মা আউলিয়া বেগম বলেন, ‘আমার পুতরে তোমরা আইন্যা দেও। কই যাইলে আমার পুতের খোঁজ পামু। আমার পুত আমারে ফোন দিয়া কইছে, আম্মা আমারে মাফ করছোনি? আম্মা আমি আর আধা ঘণ্টা বাঁচুম। আমারে শরীরে কিতা য্যান দিছে গো। আমি মইরা যাইতেছি।’ ফোনের অপর পাশ থেকে হঠাৎ কথা আসা বন্ধ হয়ে যায়। নিহতের বোন ফাহিমা বেগম বলেন, আমার ভাই আমাকে সব সময় ফোন করত। কিছুদিন পরপর দালালরা ভিডিও কলে ভাইকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেখাত আর টাকা চাইত। টাকা নেওয়ার পরও কেন আমার ভাইকে ওরা হত্যা করল?
লিবিয়াফেরত ধরমণ্ডল গ্রামের ভুক্তভোগী মাসুক মিয়া ও মমিন মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামে বেশ কয়েকজন মানব পাচারকারী আছে। এর মধ্যে লিলু মিয়া, শামীম ও শাফি আলম অন্যতম। ওরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ২০০ লোককে একসঙ্গে ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে একটি মরুভূমিতে আটকে রাখে। আমাদের কাছ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা নিয়ে লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। আমরা চোখের সামনে মানুষকে টাকার জন্য পিটিয়ে হত্যা করতে দেখেছি। আমরা কীভাবে বেঁচে ফিরেছি, আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।
গত বছরের আগস্টের শুরুতে স্থানীয় দালাল শিপন খানের প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশ ছাড়েন মাদারীপুরের তরুণ সাইদুল ব্যাপারী (২৩)। তাঁকে ঢাকা থেকে সরাসরি দুবাই নেওয়া হয়। দুবাই শহরে কয়েক দিন রাখার পরে নেওয়া হয় লিবিয়ায়। লিবিয়ার বিমানবন্দরে পেঁৗছানোর পরেই সেখানে মাফিয়া (দালাল চক্র) সাইদুলকে জিম্মি করে একটি বন্দিশালায় আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায়। ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণের মাধ্যমে সাইদুলকে মুক্ত করে তাঁর পরিবার। এরপর বাংলাদেশি এক দালালের মাধ্যমে সাইদুলের পরিবার আরও ১৬ লাখ টাকায় ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ করেন। চুক্তিতে বলা হয়, যেভাবেই হোক সাইদুলকে ইতালিতে পেঁৗছে দেওয়া হবে। তবে মাফিয়াদের নির্যাতন সইতে না পেরে ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় মারা যান সাইদুল। ফোনে সাইদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তাঁর পরিবার বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অন্য অভিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের মাধ্যমে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে সাইদুলের পরিবার জানতে পারে সাইদুল ইতালি পেঁৗছানোর আগেই মারা গেছেন। তার লাশ দালালেরা নৌকায় করে অন্য অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে ইতালিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাইদুলের বাবা শহিদুল ব্যাপারী বলেন, দালাল শিপনের মাধ্যমে ছেলেরে ইতালিতে পাঠাইতে চাইছিলাম। ধরা খাওয়ার পরে লিবিয়ার দালাল আমার ছেলেকে বন্দী করে রাখে। এরপর নির্যাতন করে ধাপে ধাপে ৪০ লাখ টাকা নেয়। সাইদুলকে তিন বেলা ঠিকমতো খাইতেও দিত না। আমার পোলাডা অনেক কষ্ট করছে। তবুও ওর স্বপ্ন ছিল ইতালি যাইবো। তাই দালালের কথামতো ভিটেমাটি যা ছিল, সব বেচে দিয়ে ছেলেকে ইতালি নিতে দালালের সঙ্গে “বডি কন্ট্রাক্ট” করি। কিন্তু দালাল আমাগো ভুল বুঝাইছে। এত দিন খালি সাইদুল বাঁইচা আছে, বাঁইচা আছে বলত। এখন যখন আমরা সত্য ঘটনা জানছি, তারপর থেকেই দালালের খবর পাইতাছি না। আমার ছেলেকে হত্যার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার চাই। এদিকে ঘটনাটি টাকা দিয়ে মীমাংসার জন্য স্থানীয় মাতব্বরেরা চাপ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন শহিদুল ব্যাপারী। অভিযুক্ত দালাল শিপন খান বলেন, ঘটনাটির মীমাংসা হয়েছে। নতুন করে অভিযোগের বিষয়ে বলার কিছু নেই। লিবিয়া দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে একটি দুর্ঘটনায় সাইদুলের মৃত্যু হয়েছে বলেও দাবি করেন শিপন খান।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর শহরের লক্ষ্মীপুর এলাকার সুমন মিয়া (৪২) চাল ব্যবসায়ী ছিলেন। বছরখানেক ধরে ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। ইতালি যেতে চার মাস আগে দেশ ছাড়েন। লিবিয়া পর্যন্ত পেঁৗছান নিজ উদ্যোগে। সেখানে গিয়ে দাদা নামের একজন দালালের খপ্পরে পড়েন। দাদার মাধ্যমে পরিচয় হয় ভৈরব উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শম্ভুপুর গ্রামের চাঁন মিয়ার মেয়ে সুইটি বেগমের সঙ্গে। সুইটির স্বামী মোজাম্মেল হক ইতালি লোক পাঠান। বর্তমানে দেশে রয়েছেন সুইটি। সমুদ্রপথে ইতালি পেঁৗছানোর প্রতিশ্রুতিতে সুমনের পরিবারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেন সুইটি। কথা ছিল, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ইতালি পেঁৗছে দেবেন। গত ২৯ জানুয়ারি খবর আসে সুমন ইতালি পেঁৗছাতে পারেননি, মারা গেছেন। সুমনের স্ত্রী তানজিনা বেগম বলেন, সুইটিকে ১০ লাখ টাকা দেওয়া ছাড়াও অন্য দালালকে বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। জমি, স্বর্ণালংকার বিক্রি ও ধার করে এই টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল। আমার স্বামীর সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় ২৩ জানুয়ারি। তখন তিনি আমাকে জানিয়েছেন দালাল চক্র তার সঙ্গে টালবাহানা করছে। স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর দালাল সুইটির কাছে যাই। সুইটি তখন জানান, আমার স্বামী ইতালি পৌঁছে গেছে। সুইটি মৃত্যুর কথা স্বীকার করেনি।
লিবিয়া থেকে নৌযানে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময়ে ৫৬ জন আরোহী নিয়ে একটি নৌযান গত ২৫ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়। এরপর ২৮ থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ২৩টি মরদেহ সৈকতে ভেসে আসে। গলিত ওই মরদেহগুলোর পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া গেলেও স্থানীয় সূত্রের বরাতে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশি। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে বাংলাদেশ দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, ২৩ জনের মরদেহ উদ্ধারের পর লিবিয়ার ব্রেগা অঞ্চলের আজদাদিয়া হাসপাতালে গোসল করানো হয়। সেই কাজে একজন বাংলাদেশি যুক্ত ছিলেন। গলিত লাশের অবয়ব দেখে তার মনে হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের সবাই বাংলাদেশি। আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার হওয়া দুজন বেনগাজি মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তাদের পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ভেসে আসা ২৩ জনের একজন হলেন সাত্তার খন্দকার (৪০)। ভিটে মাটি বিক্রি ও সুদে টাকা নিয়ে গত বছরের ১৭ নভেম্বর ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন । প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাইয়ে যান। সেখানে কয়েক দিন থেকে সৌদি ও মিশর হয়ে লিবিয়ায় যান। এরপর তাকে লিবিয়ার আজদাবিয়া শহরের একটি বন্দিশালায় রাখা হয়। তার বড় ভাই আবুল খায়ের খন্দকার বলেন, দুবাই—সৌদি—মিশর হয়ে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর লিবিয়া পেঁৗছায়। সেখানে গেম ঘরে (বন্দিশালা) জিম্মি রেখে আমার নিকট থেকে ২৬ লাখ টাকা আদায় করে। সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি সে জানায় আজ আমাদের থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নিবে। তাড়াতাড়ি গেম দিবে (ভূমধ্য সাগর পার করে দিবে)। ২৮ জানুয়ারি আমার বোনের মেয়ে (ভাগ্নী) সুইটি সুলতানা লিবিয়ান একটা পেজের (লিবিয়া ইতালী গেম খবর পেজ) মাধ্যমে দুর্ঘটনার বিষয় জানতে পারে। ওই পেজে আজদাবিয়া শহরের উপকূলের একজন ব্যবসায়ি কমেন্টে জানান তিনি এই দুর্ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তার নাম আইয়ূব শেখ, বাড়ি বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায়। তখন ওই ব্যবসায়ির সাথে যোগাযোগ করলে তিনি লিবিয়ার প্রশাসনের ভয়ে সব তথ্য জানতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি ওই উপকূলের দায়িত্বরত একজন লিবিয়ার কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। ওই কর্মকর্তা নৌ দুর্ঘনায় নিহতদের ছবি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে দেখায়। সেখাসে আমার ভাইয়ের ছবি দেখে নিশ্চিত হই যে সে আর পৃথিবীতে নেই।
জানুয়ারি মাসেই চিরতরে স্বপ্নের দেশে হারিয়ে গেছেন আবুল বাসার আকন (৩২), টিটু হাওলাদার (১৯), হৃদয় হাওলাদার (২২), রাসেল হাওলাদার (২২), আরাফসান আশিক (১৮), রফিকুল শেখ (২০), বাবা রাজি না হওয়ায় তাকে না জানিয়ে ফুফুর কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা নিয়ে ইতালি যাওয়া সুজন ফরাজী। ২৩ জানুয়ারির পর থেকে সবার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। হৃদয়ের বাবা মিন্টু হাওলাদার বলেন, ছেলেকে সাগরের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে ইমোতে লাশের ছবি পাঠিয়েছে দালাল চক্র। ছেলেকে ইতালি পাঠানোর জন্য ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন দালালেরা। রাসেলের বাবা মজিবর হাওলাদার বলেন, প্রায় এক মাস ধরে ওই তরুণেরা লিবিয়ায় ছিলেন। ২৪ জানুয়ারি তাদের ইতালিগামী ট্রলারে উঠিয়ে দেওয়ার কথা জানায় দালাল চক্র। এরপর সপ্তাহ কেটে গেলেও ছেলের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি। দালালেরা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য জানাচ্ছিল। কখনো জানায় তারা হাসপাতালে, আবার কখনো দাবি করে তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। ফেসবুকে রাসেলের লাশের ছবি দেখতে পেয়েছেন তারা। সমুদ্রের পাড়ে পড়ে ছিল লাশটি।
গত ১৪ জানুয়ারি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে ২০ বছর বয়সী মামুন শেখ ও সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে ২৫ বছর বয়সী সজল বৈরাগীসহ বেশ কয়েকজন যুবক ইতালির উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রওনা দেন তারা। ৩২ জন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নৌকায় ৫২ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে নিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ১৫ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে ইঞ্জিনচালিত নৌকার তলা ফেটে যায়। এতে মামুন ও সজলসহ মারা যান ১২ জন। পরে খবর পেয়ে বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড। এ ছাড়া এখনও নিখেঁাজ গোহালা ইউনিয়নের পান্নু শেখের ছেলে আপন শেখ। মামুন শেখের বড় ভাই সজিব শেখ ও সজল বৈরাগীর বাবা সুনীল বৈরাগীর অভিযোগ, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের মোশারফ কাজী প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে নেয় ১৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন। সরকারিভাবে তাদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা।
এতো গেল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার গা শিউরে ওঠা কাহিনী। টানা তিন মাস লিবিয়ার বন্দিশালায় অমানুষিক নির্যাতনের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় মাদারীপুরের রাকিব মহাজন! অথচ তার মুক্তির জন্য গত তিন বছরে মাফিয়াদের দফায় দফায় ৪২ লাখ টাকা দিয়েছে রাকিবের পরিবার। গত ২২ জানুয়ারি মৃত্যু হয় রাকিবের। এখন তার পরিবার শেষবার একটু ছুঁয়ে দেখতে চায় সন্তানকে!
অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার অন্যতম একটি পথ লিবিয়া। এ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মূলত ব্যবহার করা হয় ছোট ছোট নৌকা। এসব নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হয়। প্রতিবছর এ পথে যাত্রা করতে গিয়ে প্রাণ হারান অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী। এ জন্য এ কাজে দালালেরা চালু করেছেন ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় যত দিন লাগুক, অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ইতালি জীবিত পেঁৗছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে টাকা নেন দালালেরা। আবার দালালদেরই একটি চক্র লিবিয়ায় ইতালিগামী তরুণদের বন্দিশিবিরে আটক করে নির্যাতন চালায়। দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করার পরই কাউকে ছেড়ে দেওয়া হয় অথবা জীবনের সব হিসেব নিকেশ চুকিয়ে অন্য পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে লিবিয়ায় আটকে পড়া ৩ হাজার ১৬৪ জন বাংলাদেশিকে ২০২৪ সালে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১১ থেকে গত ২০২৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৪৩ হাজার বাংলাদেশি নাগরিককে লিবিয়া থেকে ফেরত আনা হয়। প্রতি বছর লিবিয়া থেকে প্রায় ৪০০ বাংলাদেশির মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ উপায়ে ইউরোপ বা বিদেশযাত্রায় আটকে পড়া ৪ হাজার ৮৬৫ জন বাংলাদেশিকে ২০১৪ সালে সরকার বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে আনে। যার মধ্যে লিবিয়া থেকে ৩ হাজার ১৬৪ জন, লেবানন থেকে ১ হাজার ২৯২, ওমান থেকে ১৮১, তিউনিশিয়া থেকে ১১৭, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ৭০, কম্বোডিয়া থেকে ৩০ এবং জর্ডান থেকে ১১ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০২৪ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে ৮৫ জন বাংলাদেশির মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। গত ১০ বছর যাবত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যারা ইউরোপে যান, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৮৪ হাজার বাংলাদেশি এভাবে সমুদ্রপথে ইউরোপে গেছেন। প্রতি বছর গড়ে অন্তত ১০০ জন বাংলাদেশি নৌকা ডুবিতে মারা যান। অভিবাসনবিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনির বলেন, এর সঙ্গে শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক চক্রও জড়িত।
আমাদের দেশে বারবার আন্দোলন হয়, সংগ্রাম হয়, এমনকি অভ্যুত্থানও হয়। পরিবর্তন আসে রাজনীতিতে, পাল্টে যায় বিধি—সংবিধান। কিন্তু বদলায় না কেবল দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য। অধিক উপার্জনের আশায়, উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর মানুষ আগে যেমন কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দিত, এখনও তেমনই দিচ্ছে। সময় বদলেছে, কিন্তু দালালদের প্রতারণা, অসহায় মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়া কিংবা লাশ হয়ে ফিরে আসার করুণ চিত্র আজও রয়ে গেছে একই রকম। ভালো জীবনযাপনের আশায় অনেক মানুষ বিদেশ গমন করেন। রঙিন স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপ নেয় লিবিয়ার গেমঘরে! দালাল বা মাফিয়াদের হাতে বন্দি থেকে! রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) তথ্য মতে, গত ১০ বছরে সমুদ্রপথে বিদেশ যেতে নিহত বা নিখেঁাজ হয়েছে ১০ হাজার বাংলাদেশি। পাচার হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ। আর বিদেশি কারাগারে বাংলাদেশি বন্দি রয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি। তবুও বিদেশ যাত্রা ‘নাহি মানে পরাভব!’
বৈশ্বিক অভিবাসীর উৎস তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। কর্মসংস্থানের জন্য প্রতি বছর বিদেশে পাড়ি দেন গড়ে অন্তত ১০ লাখ মানুষ। এ মানুষগুলোর জীবনের নিরাপত্তা দেয়া সরকারেরই দায়িত্ব। দালাল চক্র যেন অবৈধ পথে কর্মী পাঠানো, মানব পাচারের মতো অপরাধ করতে না পারে সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এসব অপরাধ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ঘটতে দেখা যায়। সুতরাং সিন্ডিকেট, রিক্রুটিং এজেন্সি, দালাল—সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন। যাতে ভবিষ্যতে মানব পাচারের নতুন কোনো সক্রিয় সিন্ডিকেট তৈরি না হয়। বিদেশে মানব পাচার বন্ধ করতে হলে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। বাংলাদেশি তরুণদের এই মৃত্যুযাত্রা সরকারকেই থামাতে হবে। অতীতে এ রকম অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কেননা এ চক্রের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই ছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি নিতে হবে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে অভিবাসন খাতে দেশের ভাবমূর্তি ফেরানো প্রয়োজন। আমরা আশা করি, এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেবে এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। মানব পাচারের মতো ভয়ংকর অপরাধ দমন করা শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিক, গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সূত্র: জাতীয় ও অনলাইন পত্রিকা
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?