২০২৪ সালে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের প্রবাসীর সংখ্যা কত তা নিয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ করেছে। ২০২৪ সালে সারাবিশ্বে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে একটি পরিসংখ্যান অনুসারে সেই সংখ্যা বর্তমানে আনুমানিক ১৩.৫ মিলিয়ন। এ ছাড়া জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ৪৮ লাখের বেশি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মতে, বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ১ কোটি ৫৫ লাখ। প্রতিটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রবাসে বাংলাদেশির সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধির পথে হাঁটছে। এই বিরাট জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে বাংলাদেশে একের পর এক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশি যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, তাদের মধ্যে বহুদিন থেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। বাংলাদেশিরা যদি দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে ইইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে সিটি কাউন্সিল, কাউন্টি কাউন্সিল এমনকি পার্লামেন্ট নির্বাচনে পর্যন্ত অংশগ্রহণ করার সুযোগ রাখেন, তাহলে জন্মগত সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোতে ভোটদান ও অংশগ্রহণে বাধা আসবে কেন? সুইডেনে বাংলাদেশি নাগরিকদের যখন সুইডিশ নাগরিকত্ব দেওয়া হয় তখন সেখানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকে, আপনি সুইডিশ নাগরিক হলেও আপনার আগের নাগরিকত্ব বহাল রয়েছে। এখন আপনি যদি আপনার আগের নাগরিকত্ব রাখতে না চান তাহলে আপনার দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এখানেই সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের দ্বৈত নাগরিকত্ব পরিষ্কারভাবে সামনে আসছে। তবু কেন বাংলাদেশে আসছে এই বাধা?
বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতিতে এক বিরাট শক্তি। প্রবাসীরা এ ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তারা বাংলাদেশে অর্থ বিনিয়োগের উৎসাহ দিন দিন হারিয়ে ফেলবেন। আমি এখানে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করা বাংলাদেশিদের কথা বলছি। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে যুগ যুগ ধরে অবহেলায় পড়ে আছে। প্রবাসীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হলে তারা বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং আরও বেশি রেমিট্যান্স প্রেরণে উৎসাহিত হবেন বলে আমি মনে করি। তা ছাড়া শুধু প্রবাসী হওয়ার কারণে তারা তাদের নাগরিক অধিকার হারাবেন কেন?
প্রবাসে মূলধারার রাজনীতিতে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিরা সক্রিয়। জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়া থেকে শুরু করে সিটি কাউন্সিল, কাউন্টি কাউন্সিলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সেন্ট্রাল কমিটি থেকে শুরু করে জেলা ও স্থানীয় ব্রাঞ্চগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। সুইডেনে বর্তমানে ইউরোপের বাহির থেকে আসা অনেক দেশের ইমিগ্র্যান্ট জাতীয় সংসদের সদস্য থাকলেও এখন পর্যন্ত ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে কোনো জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি। এটাকে আমি বলব আমাদের ব্যর্থতা, অনৈক্য ও বিদ্বেষ।
আমি মনে করি, প্রবাসে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা মূলধারার রাজনীতিতে আরও ব্যাপকভাবে সক্রিয় হলে ভবিষ্যতে একদিন এসব দেশের জাতীয় সংসদে আসন লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। তবে মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই সবারই থাকবে। এরই নাম গণতন্ত্র।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশন সীমিত পরিসরে হলেও প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে মিডিয়ার তথ্য অনুসারে জানা যায়, এখানে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের প্রশ্নে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। যেমন, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ভোটারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা— সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে প্রবাসীদের ভোটদানের পদ্ধতি ঠিক করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। আমার মনে হয়, এই দিকটার যৌক্তিকতা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের একটু চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের নাগরিকরা যে নিয়মের আওতায় নির্বাচনে ভোটাধিকার ও প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা লাভ করেন, প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের একইভাবে হওয়া কি উচিত নয়? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে আউট অব কান্ট্রি ভোটিং আছে, চাইলে সেখান থেকেও নির্বাচন কমিশন অভিজ্ঞতা নিতে পারে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নাসির উদ্দিন বলেছেন, আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা আমাদের ওয়াদা। তিনি এও বলেছেন, রাজনৈতিক নেতারা সমর্থন না দিলে কোনো কিছুই বাস্তবায়িত হবে না। আমি মনে করি, রাজনৈতিক নেতাদের চাওয়া না চাওয়ার ওপর নির্ভর না করে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে নিতে হবে এই সিদ্ধান্ত। তা ছাড়া আমার মনে হয় না বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এ ধরনের উদ্যোগের বিরোধিতা করবে, বরং তারা স্বাগত জানাবে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বর্তমান নির্বাচন কমিশন প্রবাসে বসবাসরত অসংখ্য বাংলাদেশিকে বাইরে রেখে একটি নির্বাচন করলে তা কতটুকু যুক্তিসংগত হবে, কমিশনের একটু হলেও ভেবে দেখা উচিত বলে আমি মনে করি। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা যখন বেঁধেছেন তখন প্রবাসীরা তার শব্দ শুনতে চায়।
লেখক : সাবেক ইলেকটেড মেম্বার, গ্রেটার স্টকহোম অ্যাসেম্বলি; ও লেফট পার্টি মনোনয়ন বোর্ড সেন্ট্রাল কমিটি
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?