clock ,

স্বাধীনতা– মার্চের চেতনা ও ইতিহাসের শিক্ষা

স্বাধীনতা– মার্চের চেতনা ও ইতিহাসের শিক্ষা

মার্চ আমাদের স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের এই মাসটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য এক উত্তাল সময়, যখন তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। কোনো জাতি যেমন কেবল অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে পারে না, তেমনি অতীতকে ভুলে গিয়েও টিকে থাকতে পারে না। অতীত আমাদের শক্তি জোগায়, বর্তমান আমাদের সাধনার পথ দেখায়, আর এই দুইয়ের সমন্বয়েই ভবিষ্যৎ হয় উজ্জ্বল।

বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গুরুত্ব ভুলে যাবে, এমন ধারণা অমূলক। নানা কারণে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য বিতর্কিত হলেও, সময়ের সাথে সাথে তা আবার তার পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসে। বিশ্বের ইতিহাসে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে নানা পরিবর্তন এলেও কিছু মৌলিক বিষয় অপরিবর্তিত থেকেই যায়। যারা এই সত্যকে অস্বীকার করে অহংকার আত্মতুষ্টিতে ভোগে, তাদের পরিণতি হয় ভয়াবহ। স্বাধীনতার মূল কথা হলো, একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে, তবে তা গ্রহণ করতে হবে। এই নীতি থেকে সরে আসার কারণেই আজকের এই পরিস্থিতি।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সামনের দিকে এগিয়ে যাব? যদি যেতে হয়, তবে আমাদের গৌরবময় অতীত এবং তার ফসলকে সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। একটি সমাজের মূল চালিকাশক্তি হলো তার শিক্ষা আইনের শাসন। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই সেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতে পারেনি। অপরিমেয় মেধা উদ্ভাবনী শক্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা তেমন উন্নতি করতে পারিনি। যখনই কোনো সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই কোনো না কোনো সমস্যা তাকে গ্রাস করে। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শিক্ষাই এর প্রধান লক্ষ্যবস্তু। আমি মনে করি, শিক্ষাই সমাজ জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে।

এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। তারুণ্য এক বিশাল শক্তি। এই শক্তিকে কাজে লাগালে কী হতে পারে, তা আমাদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। নিকট অতীতে আমরা তারুণ্যের এই শক্তি দেখেছি, যা প্রায় অচল ব্যবস্থাকেও ভেঙে দিয়েছে। এর নাম বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এর ফসল ঘরে তোলা। স্বৈরাচার তাড়িয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ডে বিতাড়িত আচরণ ফিরিয়ে আনাটা নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর। সবসময় আগ্রাসী বা উত্তেজিত থাকা সুস্থতা নয়, সুস্থতা হলো কাজ শেষে স্বাভাবিক জীবনযাপন।

স্বাধীনতার মূল কথা হলো দেশ জনগণের মঙ্গল। এই মঙ্গল তখনই সম্ভব, যখন আমলা তার কাজ করবেন, কৃষক ফসল ফলাবেন, শ্রমিক শ্রম দেবেন এবং রাজনীতি দেশ চালাবে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ মারামারি হয়েছিল। কিন্তু তারা সেই অতীতকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা জানে, ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রাখতে অতীতকে মনে রাখতে হয়।

কম্বোডিয়া ভিয়েতনাম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। দুটি দেশের মানুষই তাদের নিজেদের মধ্যকার যুদ্ধ হানাহানিকে জাদুঘরে রেখে দিয়েছে। উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণ ভিয়েতনামের যুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ যুদ্ধ। কিন্তু আজ তারা মিলেমিশে একাকার। তাদের নেতারা জানতেন, সহমর্মিতা সহযোগিতাই স্বাধীনতার মূল কথা। সায়গনের নাম পরিবর্তন করে হো চি মিন সিটি করা হলেও, সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি। ফলে হ্যানয় হো চি মিন সিটির জীবনধারা আলাদা হলেও, তারা এক দেশ, এক জাতি। বৈপরীত্যের মধ্যে এই মিলনের নামই ঐক্য স্বাধীনতা।

কম্বোডিয়ার জাদুঘরে দেশদ্রোহী বা পল পটের অনুসারীদের ক্ষমা চাওয়ার দলিল রয়েছে। এই লিখিত দলিলগুলো জরুরি, যা ভবিষ্যতে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে সাহায্য করে। আমরা এর কিছুই করতে পারিনি। তাই মধ্য ষাটের কোঠায় এসেও মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা নানা কারণে সমালোচিত হচ্ছে।

স্মৃতিপটে ভেসে ওঠা একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। প্রায় দুই শতাব্দী আগের কথা, ফরাসি বিপ্লবের সময়। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তিনজনের মধ্যে একজন গভীর ঈশ্বরবিশ্বাসী পুরোহিত, দ্বিতীয়জন আইনজীবী এবং তৃতীয়জন গবেষক, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। তাদের মাথা বলিষ্ঠ কাঠের উপর নিচু করে রাখা হয়েছিল। মাথার উপরে ঝুলছিল সাক্ষাৎ যমদূত, অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের খড়গ। দড়ি দিয়ে বাঁধা, কেবল একটি আদেশের অপেক্ষা। আদেশ পাওয়া মাত্রই খড়গের উপরের দড়ি খুলে দেওয়া হবে এবং ধারালো লৌহফলকটি অপরাধীদের মাথার ওপর নেমে আসবে, শরীর থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে দেবে।

বধ্যভূমিতে তখন মানুষের কোলাহল। সবাই একত্র হয়েছে, জনতা প্রত্যক্ষ করতে এসেছে এই ভয়াবহ মৃত্যুদৃশ্য। প্রথানুযায়ী, দোষীদের জীবনের অন্তিম মুহূর্তে শেষবারের মতো কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হলো।

প্রথমে সুযোগ পেলেন সেই আস্তিক পুরোহিত। তিনি বললেন, "হ্যাঁ, আমি একজন ভক্ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, স্বয়ং ঈশ্বর আজ আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবেন।" উপর থেকে খড়গ নিচের দিকে নেমে এলো। কিন্তু আশ্চর্য! এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল। খড়গটি সত্যি সত্যিই নিচে নেমে এলো, কিন্তু পুরোহিতের গলার কাছে এসে যেন থমকে দাঁড়াল। জনতা বিস্মিত ভীত হলো। ওই যাত্রায় পুরোহিতকে বলি দেওয়া হলো না।

এরপর আইনজীবীর পালা। তাকেও একই সুযোগ দেওয়া হলে তিনি বললেন, "না, আমি জানি আমি মরব না। যিনি সকল বিচারকের ঊর্ধ্বে, এই জগতের সমস্ত ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব-নিকাশ যার আদালতে হয়, সেই মহান সত্তা সাক্ষী আছেন, মৃত্যু কোনোভাবেই আজ আমার গলা স্পর্শ করতে পারবে না।" অলৌকিকতার পুনরাবৃত্তি ঘটল, পুরোহিতের মতোই আইনজীবীও ওই যাত্রায় রক্ষা পেলেন। তাকেও মুক্তি দেওয়া হলো।

এবার বাকি রইলেন সেই পদার্থবিদ। তাকে সুযোগ দেওয়া হলে স্বল্পভাষী পদার্থবিদ বললেন, "হ্যাঁ, আমারও কিছু বলার আছে। আমি ঈশ্বরের বিষয়ে খুব কম জানি। আপনারা যদি একটু কষ্ট করে মাথা তুলে দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন, খড়গটি দড়ি দিয়ে ঝুলছে বটে, কিন্তু দড়ির অপর প্রান্তটি একটি কপিকলের (pulley) সঙ্গে আটকানো। যেখান থেকে দড়িটি পেঁচিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, অন্য কোথাও, সম্ভবত বাইরে।"

. মিশিও কাকু, যিনি নিজে একজন বিশ্বখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, একটি উদাহরণ দিতে গিয়ে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এই গল্পটি বলেছিলেন। তার গল্পটি বলার উদ্দেশ্য ছিল, এই কথাটি বলাকখনো কখনো বিজ্ঞানীদেরও জটিল পরিস্থিতিতে কিছু সত্য ধৈর্য ধরে চেপে যাওয়াই ভালো।

বাঙালির জয়, বিজয় স্বাধীনতা যেন আমাদের সবার মঙ্গল বয়ে আনে।

লেখক: ছড়াকার, প্রাবন্ধিক কলাম লেখক। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রফেশনাল ইংরেজি পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে কাজ করেন। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে, ‘ছড়ায় গড়ায় ইতিহাস’, ‘শুধু ছড়া পঞ্চাশ’, ‘কৃষ্ণ সংস্কৃতির উত্থান পর্বে’, ‘তৃতীয় বাংলার চোখে’, ‘দূরের দুরবিনে স্বদেশউল্লেখযোগ্য। ‘The Victorious Nation’ তার গবেষণাগ্রন্থ।

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য