আমরা আসলে কেমন সমাজে বাস করি? প্রতিদিনই এমন প্রশ্ন মাথায় আসে ঘুরেফিরে। যেখানে নারীদের জন্য রাস্তা নিরাপদ নয়, কর্মস্থল নিরাপদ নয়, এমনকি বাড়ির ভেতরেও রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। অথচ প্রতিবার যখন কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, নির্যাতিত হন, তখন আমরা প্রথমেই তাকেই প্রশ্ন করি— তিনি কেন বাইরে ছিলেন? কেন রাতের বেলা বের হলেন? তার পোশাক কেমন ছিল? অথবা তার চরিত্র কেমন?
এই সমাজ কি নারীর অস্তিত্বের বিলুপ্তি চায়? এমন এক পৃথিবী চায়, যেখানে নারীর কোনো অধিকার থাকবে না, থাকবে শুধু পুরুষদের জন্য বানানো একক নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা?
সম্প্রতি প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধর্ষণের খবর আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। খবরের কাগজের শিরোনামগুলো এমন— ‘মৌলভীবাজারে তিন বছরের বাচ্চা ধর্ষণের শিকার’, ‘স্কুল ছাত্রীকে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ’, ‘বাসস্ট্যান্ড থেকে তুলে নিয়ে গৃহবধুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ’, ‘পথহারা কিশোরীকে সাহায্যের কথা বলে দলবদ্ধ ধর্ষণ’, ‘টাঙ্গাইলে প্রেমের ছলনায় তরুণীকে ধর্ষণ, বন্ধুর কাছে ভিডিও’, ‘ট্রলারে মাওয়া ঘাট পার হতে গিয়ে গৃহবধু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার’, ‘মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার শিশু’। এরকম শিরোনাম গত দু-মাসে অনেক বেশি বেশি দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের মতে, দেশে বর্তমানে ৪০ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কমপক্ষে ১ হাজার ৩০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৫০৫ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ২৬১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ১২,৫৮৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭১৭৬ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২২৫ জনকে ও আত্মহত্যা করেছেন ৫১ জন নারী। ২৬৩৯ জন নারী ও কন্যাশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৯৬ জন, আহত হয়েছেন ৩৭৫ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২০ জন নারী। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১০৬৩ জন, আহত হয়েছেন ৩৬৫ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২৭৪ জন নারী। এসিড সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৯ জন ও গুরুতর আহত হয়েছেনে ১১ জন নারী।”
আমরা কি সত্যিই আধুনিক সময়ে আছি? সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু নারীদের পুড়িয়ে হত্যা করার রীতি কি বন্ধ হয়েছে? বিংশ শতাব্দীর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের শারীরিকভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো, আজ ওই আগুন সমাজের চোখে, কথায়, নীতিতে, ব্যবস্থায়। তখনকার সমাজ বিধবা নারীকে বাঁচতে দিত না, আজ ধর্ষণের শিকার নারীকে বেঁচে থাকার অধিকার দেয় না। তাকে পোড়ানো হয় প্রতিটি প্রশ্নে, প্রতিটি অবজ্ঞায়, প্রতিটি অপমানে।
সতীদাহ প্রথা ইতিহাসের এক ভয়াবহ ও অমানবিক অধ্যায়, যেখানে হিন্দু বিধবা নারীকে স্বামীর মৃত্যুর পর তার চিতায় আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হতো। এটি শুধু একটি ধর্মীয় আচার ছিল না, বরং সমাজে নারীদের অধিকারহীনতা ও পুরুষতান্ত্রিক শাসনের একটি নির্মম দৃষ্টান্ত।
এই প্রথার মূল ভিত্তি ছিল সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস, যা নারীদের জীবনের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করত। একবার স্বামী মারা গেলে নারীর জীবন অর্থহীন হয়ে যায়— এমন ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিধবাদের স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক চিতায় বসিয়ে দেওয়া হতো। অনেক সময় পরিবার ও সমাজের চাপে নারীকে এই আত্মাহুতির পথ বেছে নিতে বাধ্য করা হতো।
তবে সতীদাহ শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের ফল ছিল না; প্রথাটি মূলত নারীদের পরাধীনতা এবং তাদের মানবিক অধিকারকে অবজ্ঞা করার একটা পদ্ধতি। নারীর কোনো সামাজিক বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ছিল না এবং তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পুরুষের সেবা ও সন্তুষ্টি। কোনো হিন্দু নারীর স্বামী মারা গেলে তাকে তার পরিবার ও সমাজ বোঝা হিসেবে দেখত। ফলে নারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা সামাজিকভাবে এক ধরনের কাঠামোগত শোষণ ছিল। সতীদাহ প্রথা একদিকে যেমন সামাজিক বৈষম্যের প্রতীক ছিল, তেমনি নারীর আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকেও সীমাবদ্ধ করেছিল। আজও আমরা কি একই কাজ করছি না? ধর্ষিত হলে, নির্যাতিত হলে, নারীর দোষ খুঁজে তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা কি সতীদাহেরই নতুন রূপ নয়!
যখন কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখন অপরাধীর বিচারের আগে আলোচনায় আসে ভুক্তভোগীর পোশাক, চরিত্র, চলাফেরা। যেন ধর্ষণ কখনোই অপরাধীর দোষ নয় বরং নারীই দায়ী। ঠিক যেমন সতীদাহের সময় বলা হতো, একজন ‘সতী’ নারী আগুনে পুড়ে মারা যায়, আর যদি সে তা না করে তাহলে সে কলঙ্কিত হবে। আজও ধর্ষণের পর নারীর সঙ্গে একই ব্যবহার করা হয়— সে যেন ধর্ষিত হওয়ার জন্যই নিজেই দায়ী।
সতীদাহে নারীকে বলি দেওয়া হতো সমাজের তথাকথিত শুদ্ধতার নামে, আজও নারীকে বলি দেওয়া হয় পুরুষতান্ত্রিক নীতির নামে। তখন নারীর শরীর পোড়ানো হতো, এখন পোড়ানো হয় তার সম্মান, তার আত্মবিশ্বাস, তার স্বপ্ন। তখন আগুনের শিখায় দগ্ধ হতো তার দেহ, আজ সমাজের দৃষ্টিতে দগ্ধ হয় তার অস্তিত্ব।
এমন কত নারীর গল্প আমরা শুনেছি, যারা ধর্ষণের বিচার চেয়েও পায়নি? যারা আদালতের চৌকাঠে পৌঁছানোর আগেই সমাজের দৃষ্টিতে অপরাধী হয়ে গেছে? যাদের পরিবার, প্রতিবেশী, এমনকি রাষ্ট্রও বুঝিয়ে দেয়— তাদের জীবনের মূল্য আর আগের মতো নেই?
এই আগুন কবে নেভানো হবে? কবে সমাজ বলবে, ধর্ষণের জন্য ধর্ষক দায়ী, পোশাক নয়? কবে বিচার হবে ভুক্তভোগীর নয়, অপরাধীর? কবে রাস্তা, কর্মক্ষেত্র, বাস, ট্রেন এমনকি নিজ গৃহ— সব জায়গায় নারী চলবে পুরুষের সমান অধিকারে?
নারীকে পোড়ানোর এই সংস্কৃতি বদলাতে হবে। নারীর নিরাপত্তা কেবল আইন দিয়ে সম্ভব নয়; প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। আমাদের লড়াই শুধু অপরাধীর শাস্তির জন্য নয় বরং সেই মানসিকতা ভাঙার জন্য— যে মানসিকতা নারীকে ঘরবন্দি রাখতে চায়।
আমরা কি এমন একটা সমাজ তৈরি করতে চাই, যেখানে রাস্তায় শুধু পুরুষেরা থাকবে? কর্মক্ষেত্রে নারীরা থাকবে না? সমাজে নারীর উপস্থিতি ধীরে ধীরে মুছে যাবে? যদি তাই হয়, তবে তা সতীদাহের চেয়েও ভয়ংকর, কারণ এটি হবে প্রতীকীভাবে নারীর অস্তিত্ববিহীন এক সমাজ তৈরি করার সূচনা।
কিন্তু এ সমাজ আমাদের নয়। আমাদের সমাজ হবে নারীবান্ধব, যেখানে কোনো নারীকে দগ্ধ করা হবে না— না আগুনে, না অপমানে, না সামাজিক বিচারহীনতার চাপে। আমাদের সমাজ হবে এমন, যেখানে নারী নিরাপদ থাকবে, তার সম্মান থাকবে, তার স্বপ্ন থাকবে, স্বপ্ন পূরণের সুযোগ ও মাধ্যম থাকবে। আর ওই সমাজ গড়তে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
সতীদাহ প্রথার ইতিহাস শুধু অতীতের এক নির্মম অধ্যায় নয়, এটি আমাদের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হয়ে থাকা উচিত। এটি দেখায় যে, কীভাবে কুসংস্কার, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও সামাজিক শোষণ নারীদের প্রতি ভয়াবহ অবিচারের রূপ নিতে পারে। নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য ইতিহাসের এই ভুলগুলো স্মরণ করা এবং এর আধুনিক পুনরাবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন।
লেখক: জন্ম ও বেড়ে ওঠা মফস্বল শহর টাঙ্গাইলে। পেশায় শিক্ষক, সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে কর্মরত আছেন। লেখাপড়া করেছেন টাঙ্গাইলের জেলা সদর স্কুল, সরকারি কুমুদিনী কলেজ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে জেন্ডার ইস্যু নিয়ে গবেষণা করছেন এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে লিখতে ভালোবাসেন।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?