ভারত ৬৪ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করেছে। কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার জেরে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিএস) বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নয়াদিল্লি জানিয়েছে, পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধ না করা পর্যন্ত চুক্তির কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে। একইসঙ্গে আরও কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তিটি এতদিন বিশ্বে অন্যতম স্থিতিশীল আন্তঃসীমান্ত পানি চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। এতে সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর মধ্যে তিনটি (সিন্ধু, ঝিলম, চেনাব) পাকিস্তান এবং তিনটি (রবি, বিয়াস, সুতলজ) ভারতকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
চুক্তির আওতায় ভারত পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর ওপর জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সীমিত সেচ প্রকল্প চালাতে পারলেও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এই সীমাবদ্ধতা পাকিস্তানের কৃষি ও পানির নিরাপত্তা নিশ্চিতে মূল ভরসা হিসেবে কাজ করত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত চুক্তি পুরোপুরি বাতিল না করলেও এই স্থগিতাদেশ পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর নিরবিচারে প্রবাহে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। যদিও বন্যার আশঙ্কায় উচ্চপ্রবাহের সময়ে ভারত পানি আটকে রাখতে পারবে না, তবে শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহের সময়সূচিতে সামান্য পরিবর্তনও পাকিস্তানের কৃষি ও সেচ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
পাকিস্তানের ৯০ শতাংশ সেচ ব্যবস্থা এই তিনটি নদীর ওপর নির্ভরশীল। দেশটির কৃষকরা মৌসুমি চাষাবাদে নির্দিষ্ট সময়মতো পানি পাওয়ার উপর নির্ভর করেন। সময়সূচিতে সামান্য হেরফের হলে ফসলের ফলন কমে যেতে পারে। পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় গঠিত স্থায়ী সিন্ধু কমিশনের মাধ্যমে এতদিন বিরোধ নিষ্পত্তি এবং তথ্য বিনিময় হয়ে আসছিল। তবে ভারত এই কাঠামো থেকে কার্যত সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ভারত নিজেও ব্রহ্মপুত্রের মতো আন্তঃসীমান্ত নদীর নিম্ন অববাহিকার দেশ, যা চীন থেকে উৎপন্ন। তাই সিন্ধু চুক্তি লঙ্ঘনের নজির ভবিষ্যতে ভারতের বিপক্ষেও ব্যবহার হতে পারে।
ইসলামাবাদ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা হতে পারে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে, ভারতের কোনো একতরফা পদক্ষেপ যুদ্ধের সমান হতে পারে।
২০১৬ সালের উরি হামলার পর থেকে ভারত-পাকিস্তান পানি সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর ২০২৩ সালে ভারত চুক্তির আর্টিকেল ১২(৩) অনুসারে চুক্তি পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব দেয়, যা পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান করে। চলতি বছরের শুরুতে দুই দেশ ভিন্ন ভিন্ন পথে জলবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া শুরু করে, যা আগে কখনো হয়নি।
সিন্ধু পানি চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। এটি পুনঃস্থাপিত হবে, নতুন করে আলোচনার ভিত্তি তৈরি হবে, নাকি চুপিসারে বিলুপ্ত হবে—তা সময়ই বলে দেবে। তবে পানি এখন শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, বরং দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের কৌশলগত অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?