দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি উৎস হলো রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয়। চলতি অর্থবছরে এই দুটি খাতেই বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে রেমিট্যান্স আয় প্রায় ২৮ শতাংশ বেড়েছে এবং রফতানি আয়ও প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে না; বরং গত ১১ মাস ধরে ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই মজুদ ওঠানামা করছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ অনুযায়ী, গত ২৯ মে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ২০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা চলতি অর্থবছরের শুরুতে (২০২৪ সালের ১ জুলাই) ছিল ২১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১১ মাসে প্রায় ১ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার কমেছে মজুদ। এই সময়ে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশে এসেছে ৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার বেশি, আর রফতানি আয়ের বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এত বড় আয় বেড়েও রিজার্ভ কেন বাড়ছে না? এর উত্তর পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রেমিট্যান্স ও রফতানির প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), বিদেশী অনুদান এবং মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ এই তিনটি ক্ষেত্রে যথেষ্ট মন্দা দেখা দিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এফডিআই কমেছে প্রায় ৩৭ কোটি ডলার, বিদেশী অনুদান কমেছে ১৮৬ কোটি ডলার এবং বিদেশী ঋণও কমেছে ১৩৬ কোটি ডলার। মোট তিনটি খাতে প্রায় ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আয় কমেছে। একই সময়ে আমদানির খরচ বেড়ে প্রায় ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এছাড়া ঋণ পরিশোধ এবং সেবা খাতের ব্যয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই-তিন বছরে ডলারের জন্য যেই সংকট ছিল, তা এখন কাটিয়ে ওঠা গেছে। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিদেশী ঋণ ও বকেয়া দায়গুলো ব্যাপক পরিমাণ পরিশোধ করা হয়েছে। এই কারণে রেমিট্যান্স ও প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি থাকলেও রিজার্ভ বাড়তে পারেনি। তবে গত তিন বছরে যে রিজার্ভের ক্ষয় হয়েছিল তা এখন বন্ধ হয়েছে। ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবেই আমদানির এলসি খুলতে পারছেন এবং বিনিময় হারও বাজারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আশা প্রকাশ করেছেন, চলতি জুন মাসে দেশের রিজার্ভ কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার বাড়বে। তিনি বলেন, ‘আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা আসার কথা রয়েছে। এতে রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। গত তিন বছরে যে ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে, তা না হলে রিজার্ভ আরো ৩-৪ বিলিয়ন ডলার বেশি থাকত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে (জুলাই) রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু) দায় পরিশোধের পর রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর ৮ মাস ধরে ১৮ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এপ্রিলে একসময় রিজার্ভ বেড়ে ২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, কিন্তু মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর দায় পরিশোধের পর পুনরায় ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। ৪ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী সেইদিন রিজার্ভ ২৬ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার দেখানো হয়।
অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী মনে করেন, শুধুমাত্র রেমিট্যান্স ও রফতানির প্রবৃদ্ধি দিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব নয়। রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য বিদেশী বিনিয়োগ ও ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি জরুরি। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল নীতির কারণে গত তিন বছর রিজার্ভে বড় ক্ষয় হয়েছে। এখন ক্ষয় বন্ধ হলেও স্থিতিশীলতার জন্য বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে না।’
রিজার্ভের অগ্রগতি না হলেও রেমিট্যান্সের বড় বৃদ্ধি দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল শেষে বিওপির ঘাটতি মাত্র ৬৬ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের একই সময় ছিল ৬৫৭ কোটি ডলার এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৮২২ কোটি ডলার। বিওপির ঘাটতি কমায় বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কম করতে হচ্ছে। এর ফলে রিজার্ভ যদিও বাড়েনি, তবে স্থিতিশীল রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?