ঢাকার লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে দুই তরুণীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, পাশাপাশি প্রতিবাদও হয়েছে। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মন্তব্যের পর ক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে।
গত শনিবার সন্ধ্যায় লালমাটিয়ায় আড়ং-এর পাশের গলিতে একটি চায়ের দোকানে বসে দুই তরুণী চা পান ও ধূমপান করছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তি ধূমপান নিয়ে আপত্তি জানিয়ে দোকান বন্ধ করতে বলেন। এতে তরুণীদের সঙ্গে তার তর্ক হয় এবং এক পর্যায়ে তাদের একজন ওই ব্যক্তির গায়ে চা ছুঁড়ে মারেন। তরুণীদের দাবি, ওই ব্যক্তি তাদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছিলেন, যার কারণে তারা এমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
এই ঘটনার পরপরই ওই ব্যক্তি আরও কয়েকজনকে ডেকে আনেন এবং তারা দুই তরুণীকে ঘিরে ফেলে। পরে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় তাদের। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তরুণীদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
এই ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “ওপেন (উন্মুক্ত) জায়গায় সিগারেট খাওয়া নারী-পুরুষ সবার জন্য নিষেধ।” তার এই বক্তব্যে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং এটিকে ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ বলে অভিহিত করেছেন।
মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবীরা বলছেন, প্রকাশ্যে ধূমপানের আইন থাকলেও, কোনও ব্যক্তি আইন নিজ হাতে তুলে নিতে পারেন না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “টং দোকানে ধূমপান করাটা কোনও পাবলিক স্পেসে ধূমপানের শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। তাছাড়া, অভিযোগ থাকলে সেটি পুলিশকে জানানো যেত। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।”
এই ঘটনার প্রতিবাদে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে একদল বিক্ষোভকারী ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কুশপুতুল দাহ করেছেন। সামাজিক মাধ্যমেও এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। অনেকেই বলছেন, এই ধরনের ঘটনাগুলোর মাধ্যমে নারীদের প্রকাশ্য স্থানে চলাফেরার স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সাংবাদিক সাঈদা গুলরুখ বলেন, “স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্য হামলাকারীদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার শামিল। এটা শুধু অপরাধ ঢেকে রাখার চেষ্টা নয়, বরং নারীদের দোষারোপ করার একটি কৌশল।”
নাদিয়া ইসলাম নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লেখেন, “আজ যদি প্রতিবাদ না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক নারী একই ধরনের হেনস্থার শিকার হবেন।”
ঘটনার পর পুলিশ জানিয়েছে, কোনও পক্ষ মামলা করেনি, কারণ দুই তরফের মধ্যে আপস-মীমাংসা হয়েছে। তবে আইনজীবীরা বলছেন, পুলিশের উচিত ছিল হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
বাংলাদেশের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, পাবলিক স্পেসে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে ‘পাবলিক স্পেস’ বলতে সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, শপিংমল, গণপরিবহন প্রভৃতি বোঝানো হয়। লালমাটিয়ার টং দোকান এ সংজ্ঞার আওতায় পড়ে কি না, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে।
এই ঘটনা নারীদের নিরাপত্তা, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া, এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে বড় প্রশ্ন তুলেছে। নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, এই ধরনের হামলাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও বাড়তে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত ছিল ঘটনার সঠিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?