ছোট একটা সমস্যাকে ভালো করে না বুঝে, আরও বড় সমস্যা তৈরির এক চমৎকার উদাহরণ হতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটি। রাজা হবু দারুণ নাখোশ, ঘর থেকে বের হলেই চরণে ধুলা লাগে— ‘মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়’। মন্ত্রী গোবুরায়কে ডেকে বললেন, এটার সমাধান করতে। মন্ত্রীর আদেশে সাড়ে সাত লক্ষ ঝাঁটা কেনা হলো। দেশ থেকে ঝেঁটিয়ে তাড়াতে হবে সব ধুলা। পরিণাম হলো, ধুলায় ধুলাময় হলো পুরো রাজ্য— ‘ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য্য’। মন্ত্রী বেচারা আবার ধুলা তাড়াবার জন্য মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক করলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একুশ লক্ষ ভিস্তি নিয়োগ করা হলো, তাদের হাতে দেয়া হলো মশক। তারা পুকুর, বিল, নদী থেকে পানি এনে ঢালল সারা রাজ্যে। মরে সাফ হয়ে গেল সব মাছ, নদীতে নৌকা চলাচল বন্ধ। কাদায় ও প্যাকে ডুবে গেল পুরো দেশটা— ‘সর্দিজ্বরে উজাড় হল দেশটা’। রাজা বললেন, ‘এমনি সব গাধা /ধুলারে মারি করিয়া দিলো কাদা!’
এই গল্পটা বলার একমাত্র কারণ হলো, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার চেষ্টায় ভালো কিছু পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। তবে সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক ছোটখাটো সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে, আরও অনেক বড় সমস্যা দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে, সেটা তারা বুঝে বা না বুঝে করছেন, বলা কঠিন। যারা বিজ্ঞ লোক, ছোট সমাধান তাদেরকে মানায় না, তারা তাদের সমস্ত পাণ্ডিত্য দিয়ে বড় সমাধান খুঁজে বের করবেন। নয়তো হবু রাজার রাজ্যের মতো ‘সর্দি—জ্বর—ধুলা—বালির’ পরিণতিতে ভুগতে হবে এদেশের জনগণকেই, সামনের দিনগুলোতে।
এই কয়দিন আগে, আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি পরিবর্তন করে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদ যোগ করার সুপারিশ করা হলো। কিন্তু যেভাবে শুধু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতীকের নিচে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তাতে সংখ্যালঘুরা— সে হোক ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু— এই সাম্য, বহুত্ববাদ ও সুবিচারে আশ্বস্ত হবেন না, তা নিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করলেই বোঝা যাবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রতীকও অনেক কথা বলে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে। একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো, দেশের চারটি পুরোনো প্রশাসনিক বিভাগ— ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনাকে চারটি আলাদা প্রদেশের মর্যাদা দেয়া। কমিশনের মতে, এই বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
তারা বলেছেন, বর্তমানে দেশের প্রশাসনিক কাঠামো বেশ কেন্দ্রীভূত। চারটি প্রদেশ গঠন করা হলে, প্রতিটি প্রদেশের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো ও শক্তিশালী সরকার থাকবে। এতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্থানীয় সমস্যাগুলোর সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ এক জাতীয় দৈনিকে লিখেছেন, “আমি সাধারণভাবে আমার লেখায় যেটা বলার চেষ্টা করেছি এবং এখনো মনে করি, সেটা হচ্ছে ভৌগোলিকভাবে এই দেশটা একটা ছোট দেশ। মানুষ হয়তো বেশি। তবে ভাষাগত, ভৌগোলিক অবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো বিভাজন নেই।”
কিন্তু বিভাজন আনা খুবই সহজ। বাংলাদেশকে মোটা দাগে একটা সমজাতিক দেশ বলা চলে, আমাদের জনসাধারণের বড় অংশটা বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাংলাতেই পড়াশোনা শুরু করে, একই ধরনের সঙ্গীত চর্চা করে হয়তো কারও পছন্দ ভাটিয়ালি, কারও বাউল, কারওবা আধুনিক। বেশিরভাগেরই পোশাক—আশাক একই, প্রতিটা অঞ্চলেই মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা রয়েছে। বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা সব এলাকায় নেই। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া অন্য জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫০টি হলেও জনসংখ্যায় তারা অনেক কম এবং তাদের বাস মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর সমুদ্র উপকূল, সিলেটের চা বাগান ও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায়। এই সব প্রয়োজনে দেশটা চার প্রদেশে বিভাজন করা হচ্ছে না। বিভাজন করা হচ্ছে শুধু ভৌগোলিক বিবেচনায় এবং শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীয়করণের নামে।
ছোট্ট এই দেশটাতে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের দূরত্ব খুব অল্প, এখন যোগাযোগব্যবস্থা বেশ ভালো, তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টায় কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে দেশের অন্য যে কোনো অঞ্চলে চলে যাওয়া যায়। প্রতিটা অঞ্চল মোবাইল যোগাযোগের আওতাভুক্ত। তাহলে এটা এমন কি সিদ্ধান্ত হলো যা আঞ্চলিকভাবে নিয়ে প্রদেশগুলো সুবিধা পাবে? বড় বড় কেন্দ্রীয় প্রকল্প ছাড়া, এখনো অন্য সব প্রকল্পের সিদ্ধান্ত স্থানীয়ভাবে নেয়া হয়। কখনো উপজেলা চেয়ারম্যান, কখনোবা আমলারা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। যারা উপজেলা চেয়ারম্যান বা সদস্য তারা সবাই স্থানীয় লোক।
পাকিস্তানের প্রদেশগুলো বা ভারতীয় রাজ্যগুলোর দিকে তাকালে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। তাদের ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থান তাদের বিভাজনকে স্বতঃস্ফূর্ত করেছে। আর আমাদের এখানে তা করা হচ্ছে খুবই কৃত্রিমভাবে। চার প্রদেশ গঠন করা আমাদের দেশ ও সমাজের সমজাতীয়তাতে বিভাজন আনবে।
বাংলাদেশে দাবি—দাওয়া নিয়ে যে ঐতিহ্য ও আসক্তি তাতে যে কোনো দাবি না মানলে ধারাবাহিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। প্রদেশ ঘোষণার পরপরই শুরু হবে যারা নিজেদের জন্য প্রদেশ চাইবেন তাদের কর্মসূচি ও আন্দোলন। সেটা রংপুর হতে পারে, হতে পারে সিলেট বা পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের তো স্বতন্ত্র অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছেই। নতুন প্রদেশের দাবি মানা কঠিন হবে। একজনের দাবি মানলে, অন্যরাও দাঁড়িয়ে যাবে নতুন প্রদেশের জন্য।
উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা প্রদেশ দাবি তো অনেক পুরানো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিহারীরা চেয়েছিল খুলনা ও রংপুর নিয়ে একটা আলাদা প্রদেশ। স্বাধীনতার পরপর কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও চেয়েছিলেন আলাদা উত্তরবঙ্গ প্রদেশ। একসময় ছোটখাটো একটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করার অভিযোগ তুলে। তারপর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদ তার রংপুরের একচ্ছত্র রাজনৈতিক অধিপত্যকে আরও বিস্তৃত করতে সারাদেশে আটটা প্রদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির একটা গ্রুপ রাজ্যের উত্তর অংশকে আলাদা করে রাজ্যে মমতা ব্যানার্জির একচ্ছত্র আধিপত্যকে খর্ব করতে চাচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ দু—দেশের উত্তরাংশকে সংযোগ করে আলাদা রাষ্ট্র বানাবার স্বপ্ন দেখছেন। উত্তরবঙ্গে আলাদা প্রদেশ করে, এসব রাজনৈতিক গ্রুপগুলোকে প্রশ্রয় দেয়া হবে। আমাদের জনগোষ্ঠী ও ভৌগোলিক সীমারেখা যতই আমরা সংহত রাখতে পারব ততই আমরা কার্যকরভাবে প্রতিকূল হুমকি রুখতে পারব।
এরপর শুরু হবে সম্পদ ভাগ নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ। আমাদের সীমিত সম্পদের নিয়ে অঞ্চলগুলোর মধ্যে মোটামুটি সম্পদের একটা সুষম বণ্টন চলে আসছে। আমাদের আমদানিভিত্তিক অর্থনীতিতে খুব বড় উন্নয়নমূলক প্রকল্প বিস্তারের সুযোগ নেই। আলাদা প্রদেশ হলেই রাজনীতিবিদরা জনগণকে চমক দেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা যোগান দেয়ার জন্য কেন্দ্রকে চাপ দেবেন। এসব অর্থনৈতিক দাবি—দাওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতায় রূপ নিতে বেশি সময় লাগবে না।
আলাদা প্রদেশের সবচেয়ে বড় সংকট দেখা যাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ সময় দলগুলোর মধ্যে চরম পর্যায়ের দলাদলি থাকে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন দলের প্রাধান্য চরম উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিবে। কেন্দ্রের সঙ্গে তিক্ততা ও ঠোকাঠুকি লেগেই থাকবে।
প্রতি প্রদেশের জন্য আলাদা সেক্রেটারিয়েট, নতুন আমলাগোষ্ঠী, প্রাদেশিক পরিষদ, প্রাদেশিক গভর্নর ও প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ বিরাট মাথাভারী জাকজমক যোগান দেবে দেশের অসহায় জনগণ। এই খরচ প্রতিবছর বাড়বে। কেন্দ্রীয় ট্যাক্সের সঙ্গে আবার হয়তো বসবে প্রাদেশিক ট্যাক্স। সবই বিকেদ্রীকরণের নামে। এই যে খরচের বোঝা, তা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। ও হঁ্যা, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা গাড়ি পাবেন না? কে আটকাবে তাদেরকে নিজেদের জন্য গাড়ির আইন করতে?
ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রদেশের নদীর পানি নিয়ে সংকট উড়িয়ে দেয়া যায় না। রাজশাহী যদি তাদের পানি সংরক্ষণের জন্য যমুনা, আপার পদ্মায় বা মধুমতীতে বাঁধ দেয় তাহলে নিম্নধারায় পদ্মা, মেঘনা ও খুলনার রূপসাতে পানি সংকট দেখা যাবে। পাকিস্তানে সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের সংকট বহু পুরানো। ভারতে গোদাবরী, কৃষ্ণ, রাভি ইত্যাদি একাধিক নদীর পানি নিয়ে রাজ্যগুলোর মধ্যে সংকট বছরের পর বছর ধরে চলছেই। প্রতিবছরই বৈঠক হচ্ছে নদী কমিশনের।
আমাদের সংস্কারবাদীরা যাই করুন, দয়া করে ভেবেচিন্তে করবেন। একবার বিভাজন হলে, আর একত্রীকরণ করা যাবে না বরং বিভাজন বাড়তেই থাকবে। যা আমাদের দরকার তা হলো প্রশাসনে গতিশীলতা। একটা আত্মপ্রত্যয়ী প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী। আর এমন একটা সরকার, যে সরকারের লোকজন, দেশের সম্পদকে নিজেদের সম্পদ ভাববেন না। আর মানুষের কথা বলার অধিকার, নিজের দেশ ও সম্পদ নিয়ে তারা যেন ভয়—ভীতি ছাড়া কথা বলতে পারে। ইতোমধ্যেই সরকারের সমালোচনা করে শহীদ মিনারে মানুষ মার খেয়েছে আর পত্রিকা অফিস গিয়ে ক্ষমতাবানরা সাংবাদিকদেরকে চাকরিচ্যুত করতে মালিককে বাধ্য করেছেন। এই ভীতিকর পরিবেশে কোনো উদ্যোগই কাঙ্ক্ষিত ফল আনবে না। অনেকগুলো প্রদেশ নেই, এটা আমাদের দেশের কোনো সমস্যা নয়। আমাদের সমস্যা, আমরা আমাদের দেশ, বিভাগ, জেলা, ইউনিয়ন কোনোটাই ভালোভাবে চালাতে পারছি না।
প্রথমেই বলেছি, এই চার প্রদেশ, অন্তত চারশত সমস্যার সৃষ্টি করবে। তার কয়েকটি বর্ণনা করেছি, আরও অনেক কিছু অনুমান করতে পারছি, কিছু কিছু অননুমেয় রয়ে গেছে। তাহলে অন্য সমস্যাগুলোর কী হবে? মনে রাখবেন, সমস্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ে। আর সমস্যাহীন অগ্রগতি হয় গাণিতিক হারে। একটা ভালো রাস্তা তৈরি করে আরেকটা ভালো রাস্তা করলে দুইটা রাস্তা হবে। একটা রাস্তা ভাঙাচোরা বানালে যাতায়াত সময় বেড়ে যাবে, ১০০টা দুর্ঘটনা হবে, রাস্তার ফাঁকে পানি জমে গর্ত আরও বড় হবে, দুদকে মামলা হবে— সমস্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তেই থাকবে। অনেকটাই জুতা আবিষ্কার গল্পের মতো। রাজার পায়ে ধুলা লাগে, এই একটা সমস্যা থেকে কত সমস্যার যে উৎপত্তি হলো, মন্ত্রী পরিষদ আগে ভাবতেই পারেনি। অপ্রতুল সূর্যের আলো, জ্বর—সর্দি—কাশি—অ্যাজমা—এলার্জি, কাদা—প্যাক, পানি সংকট, মৎস্য সংকট, নৌকা পরিবহন সংকট এবং আরও কত অজানা পরিবেশগত সংকট। অকারণে অর্থব্যয়ের কথা নাইবা বললাম— সে তো হবু রাজার আমলেও হতো এবং আধুনিক রাজারাও অহরহ করেন।
তাই আবারও বলছি, চার প্রদেশের বাংলাদেশ অন্তত চারশত সমস্যার মুখোমুখি হবে।
লেখক: কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?