বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ ও মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। এই স্বাধীনতা ছিল শুধু ভূখণ্ডের নয়, ছিল গণতন্ত্র, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও স্বনির্ভর অর্থনীতির স্বপ্ন। কিন্তু ৫৪ বছর পেরিয়ে এসেও কি আমরা সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি? মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনও যুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন-শারীরিক, মানসিক, আর্থিক দিক থেকে। তাদের জন্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ, ক্ষমতাসীনদের জন্য রাষ্ট্রের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা উন্মুক্ত!
আজ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বৈষম্য। রাজনীতির নামে চলছে স্বার্থান্বেষীদের লুটপাট, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর শোষণ। জনগণের টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন, বিদেশে সম্পদ গড়া, প্রশাসনের ওপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ-এসব স্বাভাবিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মধ্যে সাধারণ মানুষ আজ দিশেহারা। প্রশ্ন জাগে-বাংলাদেশ কি আবার স্বৈরশাসনের পথে হাঁটছে? যদি তাই হয়, তবে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের জন্য এত বছরের সংগ্রামের মূল্য কোথায়? জনগণ আজ মুক্তির পথ খুঁজছে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ। তারা শুধু দেখছে ক্ষমতালোভী দুর্নীতিবাজদের, যারা কেবল নিজেদের স্বার্থ বোঝে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি ও নাশকতার মাধ্যমে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, তা গভীর উদ্বেগের বিষয়। এই অস্থিরতা দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংস্কারের কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। বিভিন্ন পক্ষ থেকে দাবি তোলা হচ্ছে, এবার সত্যিকারের পরিবর্তন আসবে এবং পুরোনো শাসনপদ্ধতির পুনরাবৃত্তি হবে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি সত্যিই কোনো পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছি, নাকি কেবল নতুন মোড়কে পুরোনো ধারাতেই পথ চলছি? আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি দুঃখজনক বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, কিন্তু শাসনের ধরন বদলায় না। বিরোধী দলে থাকলে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন চলে, আর ক্ষমতায় এলে একই পুরোনো কৌশলে শাসন চালানো হয়। এ যেন এক চক্র, যার কোনো পরিসমাপ্তি নেই। প্রকৃত রাজনৈতিক সংস্কার তখনই সম্ভব, যখন তা রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আসবে। শুধু প্রশাসনিক নির্দেশনা বা কঠোর নিয়ম চাপিয়ে কোনো টেকসই পরিবর্তন আনা যায় না। দরকার দলগুলোর মধ্যে প্রকৃত সংলাপ, পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে ঐকমত্য এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সংস্কারের নামে যদি কেবল ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করা হয়, তবে তা গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করবে না। গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয়, যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও স্বচ্ছতা থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার পরিবেশ কেন তৈরি হয়েছে, তার নির্মোহ অনুসন্ধান কি হয়েছে? আমরা শুধু দোষারোপ করি, কিন্তু পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর উপায় খুঁজি না।
বাংলাদেশের জন্য দুর্নীতি এখন আর শুধু একটি সমস্যা নয়, এটি যেন একটি দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি তাদের দুর্নীতি ধারণা সূচক (ঈচও)-২০২৪ প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশের স্কোর ২৩, যা আগের বছরের চেয়ে ১ পয়েন্ট কম। এই স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম স্থানে রয়েছে, যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থান। এমন এক সময়ে এই প্রতিবেদন এসেছে, যখন দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে, ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, এবং সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। আমরা প্রায়ই শুনি, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, আর সেই অর্থের গন্তব্য কিছু তথাকথিত ‘কম দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশ। সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া-এসব দেশ বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া কালো টাকার অন্যতম গন্তব্য। মজার ব্যাপার হলো, এ দেশগুলোই দুর্নীতি ধারণা সূচকে ভালো অবস্থানে রয়েছে! অর্থাৎ, তারা অন্য দেশের দুর্নীতির সুবিধাভোগী হয়ে উঠেছে।
এটি স্পষ্ট যে দুর্নীতি দমনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন নীতির মূলধারায় নিয়ে আসা জরুরি। যদি তা না করা হয়, তাহলে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বে উন্নয়ন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের ওপর। বাংলাদেশ গত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের সময় দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ও সমাজ পড়েছে গভীর সংকটে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতেও একই ধরনের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে, যাতে তারা পেশাদারত্ব ও নৈতিকতার মান বজায় রেখে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে দখলদারত্ব, স্বার্থের সংঘাত এবং দলীয় রাজনৈতিক বা অন্যান্য প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে তারা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ, প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক ও সরকারি পদগুলোকে ব্যক্তিগত লাভের সুযোগ হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বন্ধ হয়। একমাত্র আইনের শাসন, দ্রুত বিচারব্যবস্থা এবং ব্যাপক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কিছুটা হলেও আশার বাণী শোনাতে সক্ষম। কিন্তু সংস্কারের নামে কালক্ষেপণের অভিযোগ কিংবা দ্রুত সংস্কার কোনোটাই যে দুর্নীতি হ্রাসে সহায়ক নয় অন্তত দুর্নীতি নির্মূলের ক্ষেত্রে সদিচ্ছাই সব নয়, ব্যাপক কাঠামোগত সংস্কার জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতার লড়াই নয়, বরং গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের জন্য এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, আমরা ক্রমেই সেই চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও আমরা যদি সেই বিচ্যুতির দায় স্বীকার না করি, তাহলে আমাদের সামনের পথ আরও অন্ধকার হতে পারে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরিবর্তনের পরও বিরোধীরা বলছে, নতুন সরকার অভিজ্ঞতার অভাবে ব্যর্থ হবে। অথচ সৎ নেতৃত্বের একমাত্র দুর্বলতা যদি অভিজ্ঞতার অভাব হয়, তবে তা সময়ের সঙ্গে দূর করা সম্ভব। কিন্তু সুবিধাভোগীরা দেশকে বিভ্রান্ত করতে চায়, ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। প্রশাসনের গাফিলতি, সশস্ত্র বাহিনীর নীরবতা এবং গণমাধ্যমের সারাক্ষণ প্রপাগান্ডা, গুজব আর মিথ্যাচারের বন্যায় দেশ ভাসছে। বাকস্বাধীনতা যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতির মূল ভিত্তি হওয়ার কথা, সেখানে সেটাই সবচেয়ে বড় উপহাসে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। দেশ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তদের উচিত নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এবং জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটানো। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা ছাড়া টেকসই পরিবর্তন সম্ভব নয়। সময়ের দাবি হলো, সত্যিকারের সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ, পারস্পরিক আস্থা এবং জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকা দরকার। অন্যথায়, যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, তা হয়তো কেবল কথার খেলাই থেকে যাবে।
জুলাই বিপ্লবের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সাম্যের বাংলাদেশ। সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির বাংলাদেশ। কিন্তু সেই বাংলাদেশের যাত্রাপথ যেন ক্রমশ বন্ধুর হয়ে পড়ছে। এ কারণেই আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে। সেনাপ্রধানও সবাইকে সতর্ক করেছেন। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, সেই আকাঙ্ক্ষার পথে আমরা এখন পর্যন্ত হাঁটতে পারিনি। সেই প্রত্যাশা অর্জনের পথে এখন নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে এবং সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কে ষড়যন্ত্র করছে, সেটা জনগণের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। জনগণ চায় সন্ত্রাসমুক্ত দেশ। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। স্বাভাবিক চলাফেরা করার গ্যারান্টি। সমস্যা শুধু খুঁজে বের করলেই হবে না, সমাধানও করতে হবে।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?