সিঙ্গাপুরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি, এই প্রক্রিয়া নিয়ে মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠনগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে গত ২৯ নভেম্বর। মাসউদ রাহিমি মেহেরজাদ নামে এক ব্যক্তিকে চাঙ্গি কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়। মাসউদ রহিমি মেহরজাদের বাবা ইরানের একটি দূরবর্তী অঞ্চলে ছিলেন, যখন তিনি শুনতে পান তার ছেলে সিঙ্গাপুরে ফাঁসিতে ঝুলতে যাচ্ছে। শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকার কারণে এবং এক সপ্তাহ আগে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার সময় নির্ধারিত হওয়ায়, তিনি ছেলের সাথে শেষবারের মতো দেখা করতে পারেননি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি এ কঠিন যাত্রা নেবার অবস্থায় ছিলেন না। ফলে বাবা ও ছেলের শেষ যোগাযোগ হয় ফোনে, ভিডিও কলের মাধ্যমে। মাসউদ (৩৫) ২০১০ সালে মাদক বহনের অপরাধে গ্রেপ্তার হন, ২০২৪ সালের নভেম্বরে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া শাখার উপ—পরিচালক ব্রায়োনি লাউ বলেন, নভেম্বরে চারটি ফাঁসির কার্যক্রমের মাধ্যমে, সিঙ্গাপুর সরকার তার নির্মম মৃত্যুদণ্ডের বিধান অব্যাহত রেখেছে। মৃত্যুদণ্ড বিরোধী প্রচারণা গ্রুপগুলো মনে করে যে সিঙ্গাপুরে বর্তমানে প্রায় ৫০ জন বন্দী মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও, সিঙ্গাপুর দাবি করে যে মৃত্যুদণ্ড ‘মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিবন্ধকতা’ এবং এটি নিশ্চিত করে যে সিঙ্গাপুর ‘বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ স্থানগুলির একটি’।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের একটি গ্রুপ নভেম্বর মাসে একযোগে বিবৃতিতে জানায়, সিঙ্গাপুরকে ক্রিমিনাল ল’ এর ওপর নির্ভরতা থেকে সরে এসে মাদক ব্যবহারের এবং মাদক ব্যবহারের সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে মানবাধিকারভিত্তিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা উচিত।
মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের দুর্দশার গল্প সাধারণত আসে সেই সব সক্রিয়কর্মীদের কাছ থেকে, যারা এই চূড়ান্ত শাস্তির বিরুদ্ধে কাজ করে এবং নিরলসভাবে তাদের অধিকার রক্ষায় লড়াই করে। সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার যে ঢেউ এসেছে, তা তাদের সবাইকে হতবাক করেছে। মৃত্যুদণ্ড বিরোধী কর্মী এবং ট্রান্সফরমেটিভ জাস্টিস কালেকটিভ (TJC)—এর সদস্য কোকিলা অন্নামালাই বলেন, “এটা একটা দুঃস্বপ্ন,”। কাজের মাধ্যমে তিনি বহু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, তারা শুধু সেই মানুষ নয়, যাদের জন্য আমরা প্রচারণা চালাই। তারা আমাদের বন্ধু, ভাইবোনের মতো। এটা আমাদের জন্য খুব কঠিন।
ইরানি পিতা এবং সিঙ্গাপুরিয় মায়ের সন্তান মাসউদের শৈশব কেটেছে ইরান ও দুবাইয়ে। ১৭ বছর বয়সে তিনি সিঙ্গাপুরে ফিরে আসেন বাধ্যতামূলক জাতীয় সেবা সম্পন্ন করতে। ২০১০ সালের মে মাসে ২০ বছর বয়সে, তিনি সিঙ্গাপুরের কেন্দ্রস্থলে একটি পেট্রল পাম্পে এক মালয়েশিয়ান ব্যক্তির সাথে দেখা করতে যান। মাসউদ ওই ব্যক্তির কাছ থেকে একটি প্যাকেট গ্রহণ করেন, এরপর চলে যান। কিছু সময় পর তাকে পুলিশ থামায়। তারা প্যাকেট এবং গাড়ির অন্যান্য ব্যাগগুলো পরীক্ষা করে মোট ৩১ গ্রাম হিরোইন (ডায়ামর্ফিন) এবং ৭৭ গ্রাম মেথঅ্যামফেটামিন উদ্ধার করা হয়।
মাসউদকে মাদক পাচারের উদ্দেশ্যে মাদক বহনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। সিঙ্গাপুরের কঠোর আইন অনুযায়ী, ১৫ গ্রাম হেরোইন বহন করলে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। মাসউদ পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে তিনি পোস্ট—ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এবং উদ্বেগে ভুগছেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে একটি অবৈধ ঋণ প্রদানের সিন্ডিকেট তাকে ফাঁসাতে মাদক ধরিয়ে দিয়েছে।
মাসউদ—এর বোন মাহনাজ তার ভাইয়ের ফাঁসি হওয়ার এক দিন আগে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন। চিঠিতে তিনি মৃত্যুদণ্ডের কারণে তাদের পিতার উপর যে নিরন্তর যন্ত্রণা নেমে এসেছে, তা বর্ণনা করেন। “আমার বাবা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, এবং তিনি কখনোই সেরে ওঠেননি। আমার এক ভাই ৭ বছর বয়সে অ্যাপেন্ডিসাইটিসে মারা গিয়েছিল...আরেকটি ছেলে হারানো, তিনি সেটা মেনে নিতে পারেননি,” তিনি লেখেন।
মাসউদ তার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আপিলের জন্য নিরলসভাবে লড়াই করেছিলেন, কিন্তু তার একাধিক আইনি চ্যালেঞ্জ ব্যর্থ হয়, যেমন সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট থারমান শানমুগারত্নমের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার আবেদনও ফলপ্রসূ হয়নি। মাসউদ—এর বোন স্মরণ করেন কিভাবে তার ভাই মৃত্যুদণ্ডের আসামি হয়েও অন্য বন্দীদের আইনি লড়াইয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন এটি তার দায়িত্ব, নিজের জীবন এবং অন্যদের জীবন বাঁচানোর জন্য লড়াই করা, এবং তিনি চান যে মৃত্যুদণ্ডের আসামিরা একে অপরের জন্য দাঁড়িয়ে একই প্রেরণা অনুভব করুক।
একটি নতুন আইনের বিরুদ্ধে সংবিধানিক চ্যালেঞ্জে ৩১ বন্দীর একটি দলকে প্রতিনিধিত্ব করার কথা ছিল মাসুদের, যা মৃত্যুদণ্ড মামলায় আপিলের পরবর্তী প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। ওই আইনি চ্যালেঞ্জের শুনানি জানুয়ারির শেষের দিকে নির্ধারিত ছিল, কিন্তু এখন তা মাসউদ—এর জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরের সেন্ট্রাল নারকোটিক্স ব্যুরো জানিয়েছে, মাসউদ—এর মৃত্যুদণ্ড তার আসন্ন উচ্চ আদালতের শুনানির আগেই কার্যকর করা হয়েছে এবং এটি তার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বা সাজা দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
কোভিড—১৯ মহামারীর কারণে দুই বছরের বিরতির পর, সিঙ্গাপুরে মৃত্যুদণ্ডের কার্যকর করার সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেড়েছে, যা দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ২০২২ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে ২৫ জন বন্দী ফাঁসির শিকার হয়েছেন এবং কর্তৃপক্ষ মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার শিথিল করার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না।
সিঙ্গাপুরের মৃত্যুদণ্ড বিরোধী আন্দোলনকারীরা সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ অব্যাহত রেখেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের আসামিদের ব্যক্তিগত কাহিনীগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে, তারা এখন সিঙ্গাপুরের বিতর্কিত মিথ্যা খবর বিরোধী আইনের অধীনে ‘সংশোধন আদেশ’ পেতে শুরু করেছেন। আন্নামালাইয়ের TJC ও ‘অনলাইন মিথ্যা তথ্য এবং প্রপাগান্ডা বিরোধী আইন (POFMA)’—এর আওতায় এসেছে, যেহেতু তারা বেশ কিছু মৃত্যুদণ্ডের মামলার পোস্ট শেয়ার করেছেন। স্পষ্টতার জন্য তাদের মূল পোস্টের সাথে একটি ‘সংশোধন নোটিশ’ যুক্ত করতে এবং সরকারের একটি ওয়েবসাইটের লিঙ্ক শেয়ার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?