রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক মহীয়সী নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জন্মদাত্রী। তাঁর কোল আলো করে এসেছিলো বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মা সারদাসুন্দরী দেবীর স্মৃতি খুবই কম। মাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনও খুব কম। সারদা দেবী যখন মারা যান তখন রবীন্দ্রনাথ নিতান্তই বালক।
শিশুকালে যখন যাত্রা শুনতে যেতেন, ঘুম পাওয়া মাত্র বাড়ির চাকর আসর থেকে তুলে নিয়ে মায়ের কাছে ঘুম পাড়িয়ে দিত। যাত্রা শুরু হওয়ার পর মা স্বয়ং তাঁকে জাগিয়ে দেবেন, এই ভরসায় তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন মায়ের কোলে কিংবা মায়ের পাশের বিছানায়। মিথ্যে অসুখের নাম করে রবীন্দ্রনাথ যখন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে যেতে চাইতেন না, তখন মা দাঁড়াতেন রবীন্দ্রনাথের উকিল হয়ে।
তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের মৃত্যু স্মৃতি নিয়ে "জীবনস্মৃতি" গ্রন্থে 'মৃত্যুশোক' পরিচ্ছদে লিখেছিলেন।
."মা'র যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অল্প ৷ অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবন-সংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পারি নাই ৷ এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন ৷ কিন্তু, তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয় — তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন ৷
যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, " ওরে তোদের কীসর্বনাশ হল রে !"
তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভৎর্সনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন— পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল ৷ স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল, কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না ৷
প্রভাতে উঠিয়া যখন মা'র মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সে- কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না ৷ বাইরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গনে খাটের উপরে শয়ান ৷ কিন্তু, মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না ৷সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে- রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর ৷
জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না ৷ কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর-দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর-একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না ৷
বেলা হইল, শ্মশান হইতে ফিরিয়া আসিলাম ; গলির মোড়ে আসিয়া তেতালায় পিতার ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিলাম—তিনি তখনো তাঁহার ঘরের সম্মুখে বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া উপাসনায় বসিয়া আছেন ৷
ছেলেবেলা’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘পেট কামড়ানি বলে ভিতরে ভিতরে বদহজমের যে একটা তাগিদ পাওয়া যায় সেটা বুঝতে পাইনি পেটে, কেবল দরকার মতো মুখে জানিয়েছি মায়ের কাছে। শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন বলে মনে হয়নি।
তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, “আচ্ছা, যা, মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়তে হবে না’। আমাদের সেকেলে মা মনে করতেন, ছেলে মাঝে মাঝে পড়া কামাই করলে এতই কী লোকসান। এখনকার মায়ের হাতে পড়লে মাস্টারের কাছে তো ফিরে যেতেই হতো তার উপরে খেতে হত কানমলা। হয়তো বা মুচকি হেসে গিলিয়ে দিতেন ক্যাস্টর অয়েল। চিরকালের জন্য আমার হতো ব্যামোটা।’
মায়ের একটা নিজস্ব মহিলা মহল ছিল অন্দরে। রবীন্দ্রনাথ একটু বড় হওয়া মাত্র ডাক পড়ত সেখানে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –‘মনে পড়ে বাড়ি-ভিতরের পাঁচিলঘেরা ছাদ। মা বসেছেন সন্ধ্যেবেলায় মাদুর পেতে, তাঁর সঙ্গিনীরা চারদিকে ঘিরে বসে গল্প করছে। ... এই সভায় আমি মাঝে মাঝে টাটকা পুঁথিপড়া বিদ্যের আমদানি করেছি, শুনিয়েছি, সূর্য পৃথিবীর থেকে ন’কোটি মাইল দূরে। ঋজুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ থেকে স্বয়ং বাল্মিকী রামায়ণের টুকরো আউড়ে দিয়েছি অনুস্বার-বিসর্গ-সুদ্ধ।
মা জানতেন না তাঁর ছেলের উচ্চারণ কত খাঁটি, তবু তার বিদ্যের পাল্লা সূর্যের ন’ কোটি মাইল রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে তাঁকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ সব শ্লোক, স্বয়ং নারদমুনি ছাড়া আর কারও মুখে শোনা যেতে পারে, এ কথা কে জানত বলো।’
জীবনস্মৃতির "প্রত্যাবর্তন পরিচ্ছদ" এও সারদা দেবীর কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন।
"পাহাড় হইতে ফিরিয়া আসার পর ছাদের উপরে মাতার বায়ুসেবনসভায় আমিই প্রধানবক্তার পদ লাভ করিয়াছিলাম। মা’র কাছে যশস্বী হইবার প্রলোভন ত্যাগ করা কঠিন এবং যশ লাভ করাটাও অত্যন্ত দুরূহ নহে।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাঠ্য বইয়ের দু-চারটে কবিতা পড়ে মা-কে অবাক করে দিতেন। শুধু তাই নয় অন্যের মুখে শোনা পাঁচালির গানও তিনি মা-কে শুনিয়ে বাহবা আদায় করেছেন। তারপর এলো মূল রামায়ণ পাঠ।
"পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মিকীর স্বরচিত অনুস্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি, এই খবরটাতে মাকে সকলের চেয়ে বেশি বিচলিত করিতে পারিয়াছিলাম। তিনি অত্যন্ত খুশি হইয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি’।
মা মনে করিনেন, আমার দ্বারা অসাধ্যসাধন হইয়াছে; তাই আর- আমাকে বিস্মিত করিয়ে দিবার অভিপ্রায়ে তিনি কহিলেন, "একবার দ্বিজেন্দ্রকে শোনা দেখি।" তখন মনে-মনে সমূহ বিপদ গনিয়া প্রচুর আপত্তি করিলাম। মা কোনমতেই শুনিলেন না। বড়দাদাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।"
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?