মুজিবনগর উপজেলার বিশ্বনাথপুর-শিবপুর সড়কের পাশে একটি নির্মাণাধীন বাগানবাড়ি দেখিয়ে স্থানীয় আবুল হোসেন বললেন, এটি মোরশেদ আলম লিপুর বাড়ি। বাগানবাড়িটির রাজকীয় নকশা ও কারুকাজ মুগ্ধ করলেও, প্রশ্ন জাগে—মাত্র ২৮ বছর বয়সী লিপুর আয়ের উৎস কী? এলাকাবাসীর ধারণা, তার দৃশ্যমান কোনো বৈধ আয়ের উৎস নেই। অথচ কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি বিলাসবহুল ভবন, রাজকীয় ফটক, গরু ও মাছের খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। তার বহরে বিলাসবহুল গাড়ি, দেহরক্ষী, এবং অন্তত ১০টি প্রাইভেটকার ও ৩০টি মোটরসাইকেল। স্থানীয় যুবকদের কাছে লিপু যেন আইকন। কিন্তু লিপুর আয়ের উৎস খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, তিনি আসলে অনলাইন জুয়ার নিয়ন্ত্রক। মেহেরপুর অনলাইন জুয়ার রাজধানী হলেও এর মূল হেডকোয়ার্টার রাশিয়ায়। রাশিয়া থেকে এসব জুয়ার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয়।
মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রাম একসময় হতদরিদ্র মানুষের বসবাসের জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন এটি পরিচিত কোটিপতিদের গ্রাম হিসেবে। এখানে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মইনুদ্দিন, যিনি ‘ময়না মেম্বার’ নামে পরিচিত, একজন ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা। তার ভাই মশিউর রহমান বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ময়না মেম্বারের নামে তিনটি রাজকীয় বাড়ি এবং মেহেরপুর শহরে আরও একটি ছয়তলা ভবন রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, তিনিও অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে এসব সম্পদ গড়েছেন।
এমনকি মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর এবং গাংনী উপজেলার তিন শতাধিক অনলাইন জুয়ার এজেন্ট, মাস্টার এজেন্ট এবং সাব-এজেন্ট রয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক। অন্যদিকে, জুয়া খেলতে গিয়ে বহু যুবক সর্বস্ব হারিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।
অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্থ পাচারের প্রধান উপায় হলো অবৈধ হুন্ডি। এই প্রক্রিয়ায় মোবাইল ব্যাংকিং এবং কোর ব্যাংকিং ডিপোজিটের অনলাইন ট্রান্সফার চ্যানেল ব্যবহার করা হয়। অসাধু মোবাইল ব্যাংকিং ও কোর ব্যাংকিং কর্মকর্তারা এই কার্যক্রমে সহায়তা করে। পাচার করা অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে দুবাই, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর ও লেবাননে পাঠানো হয়। সেখানে এই অর্থ ক্রিপ্টোকারেন্সি-তে রূপান্তরিত হয়, যা ইউএসডিটি আকারে ভার্চুয়ালভাবে বাংলাদেশে ফিরে আসে।
দেশীয় এজেন্টরা মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে ‘বাইন্যান্স’ নামক অ্যাপে বিনিয়োগ করেন। এই অ্যাপ ব্যবহার করে ডিলাররা টাকা ডলারে রূপান্তর করে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েনে রূপান্তরিত করে তা জুয়ার সাইটের মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেন।
হুন্ডির
মাধ্যমে পাচার করা অর্থ ক্রিপ্টোকারেন্সি
আকারে ভার্চুয়াল ইউএসডিটি হয়ে এজেন্টদের অ্যাকাউন্টে
ফেরত আসে। তবে, এই
অর্থ বাংলাদেশে তোলা সম্ভব হয়
না। বরং, এটি বিদেশে
থাকা বেটিং সাইটগুলোর প্রি-পেমেন্ট হিসেবে
ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়-এর মতো মোবাইল
ব্যাংকিং এজেন্ট সিম এই প্রক্রিয়ার
সঙ্গে যুক্ত থাকে। যখন কোনো জুয়াড়ি
জুয়ার অ্যাপে টাকা ডিপোজিট করেন,
তখন এজেন্টদের অ্যাকাউন্ট থেকে ইউএসডিটি মাইনাস
হতে থাকে। একবার ইউএসডিটি ফুরিয়ে গেলে, এজেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং থেকে অর্থ উত্তোলন
করে হুন্ডির মাধ্যমে আবার বিদেশে পাঠায়
এবং ইউএসডিটি রিফিল করে। এভাবেই দিনের
পর দিন অর্থ পাচারের
এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।
অনলাইন
জুয়ার মূল সাইটগুলো রাশিয়া
থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। জানা গেছে,
মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরের অন্তত অর্ধশত প্রবাসী রাশিয়া থেকে এই সাইটগুলো
পরিচালনা করেন। এজেন্টরা এই সাইট ও
অ্যাপগুলো স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে মাসে ৩-৪ কোটি টাকা
পাচার করেন।
জুয়ার সাইটগুলোতে ব্যবহৃত দুটি অ্যাপস—রেডি
অ্যাপস ও ম্যানেজমেন্ট অ্যাপস।
রেডি অ্যাপস রাশিয়া থেকে এবং ম্যানেজমেন্ট
অ্যাপস বাংলাদেশ থেকে আর্থিক লেনদেন
নিশ্চিত করে। রেডি অ্যাপসের
সঙ্গে যুক্ত না হয়ে ম্যানেজমেন্ট
অ্যাপস কার্যকর হয় না। মোবাইল
ব্যাংকিং সেবা, বিশেষ করে নগদ, বিকাশ,
রকেট, এবং উপায়, এই
প্রক্রিয়ার অন্যতম চ্যানেল।
দুবাই প্রবাসী মাহফুজুর রহমান নবাব দাবি করেন, বিএনপির রাজনীতি করার কারণে তাকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি বলেন, "আমার চলাফেরা বা চেনাজানা লোকদের সঙ্গে মামলায় উল্লেখিতদের কোনো সম্পর্ক নেই।"
মোরশেদ আলম লিপু জানান, "সিআইডি আমার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং তদন্ত করছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে, অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন ইউটিউবসহ বিভিন্ন চ্যানেলে অবাধে ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলো বন্ধ করা হলে সমস্যার সমাধান সহজ হতো।"
দেলোয়ার হোসেন দিপু বলেন, তাকে একাধিক মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তিনি জানান, "সিআইডি একবার আমার সিমের তথ্য নিয়েছে, তবে তারপর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।"
মেহেরপুর জেলা পুলিশ সুপার মাকসুদা আক্তার খানম বলেন, "২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী অনলাইন জুয়ার অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। তবে, ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হলে এই ধারাটি রহিত করা হয়।" তিনি আরও জানান, মানি লন্ডারিং তদন্তের দায়িত্ব সিআইডির হাতে থাকায় তদন্তের গতি কমার কোনো সুযোগ নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিলুর রহমান বলেন, "আইন পরিবর্তনের ফলে অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না, এটি সঠিক নয়।" তিনি আরও বলেন, প্রচলিত আইন যথেষ্ট, শুধু সদিচ্ছার প্রয়োজন।
সিপিবি নেতা মিজানুর রহমান বলেন, "অনলাইন জুয়া যুবসমাজকে ধ্বংস করছে। এতে আর্থিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি সামাজিক অপরাধও বাড়ছে।"
মেহেরপুর জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা তাজ উদ্দিন বলেন, "জুয়া ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।"
অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্থ পাচার এবং এর ভয়াবহ প্রভাব সমাজ ও অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। কঠোর আইন প্রয়োগ এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এই অপরাধের শাস্তি সর্বনিম্ন ৪ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের জরিমানা বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?