কিছু অভিবাসী শ্রমিক তাদের নিয়োগকর্তার কাছ থেকে বেতন বৈষম্যের শিকার হন, তবে চাকরি হারানোর ভয়ে তারা প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। নিজ দেশে উচ্চ বেকারত্বের হার এবং বিদেশে চাকরি পাওয়ার অনিশ্চয়তার পাশাপাশি এজেন্ট ফি’র বিশাল ব্যয় — সব মিলে চাকরি হারানোর ভয় তাদের অনেকটাই নিরব ও অসহায় করে তোলে।
সালমান (এটি তার প্রকৃত নাম নয়) এমন একজন অভিবাসী শ্রমিক। তিনি একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ইলেকট্রিশিয়ান, যাকে এস—পাসের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী তার মাসিক বেতন ছিল ৪,০০০ ডলার। এই বেতনটি তার মূল বেতন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল এবং যদি তার কাজ শারীরিক পরিশ্রমের অন্তভুর্ক্ত হয়, তবে ওভারটাইম বেতন পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। সাধারণত এস—পাসধারীদের বেতন সবসময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রদান করার নিয়ম রয়েছে।
কিন্তু কাজে যোগ দিয়ে সালমান তার মাসিক বেতনে অমিল লক্ষ্য করেন। চুক্তির ৪,০০০— ডলারের কাছাকাছি কিছুই তাকে দেওয়া হয়নি। তাকে নগদ পেমেন্ট করা হয়েছে। মাস শেষে তাকে যা দেওয়া হয়েছে তার পরিমাণ ২১০০ থেকে ২৪০০ ডলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কোনো পে—স্লিপ না পাওয়ায়, তিনি কখনোই বুঝতে পারেননি যে এই পরিমাণ কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে। এটা দেখাচ্ছিল যে তার বেতন ঘন্টাভিত্তিক হিসাব করা হয়েছে, কিন্তু ঘন্টা প্রতি তাকে কত দেওয়া হচ্ছে সেটাও উল্লেখ করা ছিলো না।
নিয়োগকর্তা কতৃর্ক বেতন ঘন্টা হিসেবে দেওয়ার বিষয়ে সালমান বলেন, যেখানে ইলেকট্রিক্যাল ইনস্টলেশন করতে হয় সেখানে তাকে পাঠানো হতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলি ছোটখাটো সংস্কার বা নতুন দোকানে স্থাপনের কাজ। যখন কোনো ইলেকট্রিক্যাল কাজ না থাকত, তখন তাকে প্লাস্টারিংয়ের মতো অন্যান্য কাজে সহায়তা করতে হতো। কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে প্রতিদিন কাজ শুরুর সময় এবং দিন শেষে তিনি সাইটের ছবি বসকে পাঠাতেন। এটি একদিকে কাজ সম্পন্ন হওয়ার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো, অন্যদিকে ছবির সময় দেখে তার কাজের সময় নির্ধারণ সম্ভব হতো। এভাবেই হয়তো নিয়োগকর্তা তার কর্মঘণ্টা গণনা করেছে বলে জানান তিনি।
সিঙ্গাপুরে প্রথম কয়েক মাস, সালমান তার চাকরিটি খুব মূল্যবান মনে করতেন। এটি তাকে বাংলাদেশে তার পরিবারের জন্য অর্থ পাঠানোর সুযোগ দিয়েছিল। তার লক্ষ্য ছিল কঠোর পরিশ্রম করা এবং চাকরিটি ধরে রাখা। অন্যান্যদের মতোই নতুন চাকরিতে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সালমান।
তবুও, বেতনের অসঙ্গতি নিয়ে তিনি তার বসকে প্রশ্ন করেন। বস বারবার বিভিন্ন অজুহাত দেন। আমি সব সময় তাকে চাপ দিতে পারি না কারণ যখন আমি সম্পূর্ণ বেতন দেওয়ার কথা বলি, তখন তিনি বলেন, অর্থনীতি ভালো না, আমার ব্যবসা ভালো না। ব্যবসা ভালো হলে পরে আমি দেব। আমি তাকে বিশ্বাস করতাম কারণ তিনি আমার নিয়োগকর্তা। এজন্যই আমি তাকে বেশি চাপ দিতাম না। প্রথম দিকে সালমান তাকে বিশ্বাস করেন এবং সহানুভূতিশীল হন। কিন্তু সময়ের সাথে তার বিশ্বাস ভেঙে যায় এবং উদ্বেগ ও হতাশা তার মধ্যে বাসা বাঁধে।
শুধু সালমান নয়, তার সহকর্মীরাও একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। কিন্তু তারা কেউই প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি। তারা বসকে রাগানোর, চাকরি হারানোর, এমনকি দেশে ফেরত পাঠানোর ভয়ে নীরব ছিলেন। সালমান বলেন, আমি তো শুধু একজন শ্রমিক। তার কথায় ফুটে ওঠে তিক্ততা অভিব্যক্তিতে অসহায়ত্ব।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে, এক সকালে তার ভয় সত্যি হয়। সেদিন তার বস তাকে কোনো কাজ দেননি এবং তাকে ডরমিটরিতে থাকতে বলেন। সন্দেহ হওয়ায় তিনি তার S পাস পরীক্ষা করেন এবং দেখেন এটি বাতিল করা হয়েছে। যখন তিনি তার বসকে প্রশ্ন করেন, বস জানান, তিনি কিছু করেননি। কোটা সমস্যা দেখিয়ে জনশক্তি মন্ত্রণালয় এটি বাতিল করেছে। সালমান এটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় ভয় তখন বাস্তব হয়েছে। অন্য অর্থে, তিনি তখন ভয়ের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পান। চাকরি হারানোর পর, তিনি নিয়োগকর্তার নিকট থেকে বেতন কম পাওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করতে সাহস অর্জন করেন। বসের ‘দেশে ফেরত পাঠানোর’ হুমকি তখন তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। এখন, তিনি সত্য প্রকাশ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সালমানের অভিজ্ঞতা এমন অনেক অভিবাসী শ্রমিকের গল্প বলে যারা বেতন বৈষম্যের শিকার হন কিন্তু নীরব থাকেন। আইনি সুরক্ষা এবং প্রতিকার প্রক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও, এরকম সমস্যাগুলো সম্পর্কে বলতেও ব্যক্তিগত সাহসের প্রয়োজন হয়।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?