clock ,

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের যেসব দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের যেসব দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেই বেশ কিছু বিষয়ে বিশ্ববাসীর জন্য বার্তা দিয়েছেন। ওই দিনই তিনি কমবেশি ৫০টি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। সেগুলোতেও রয়েছে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের পররাষ্ট্রনীতির আভাস। 

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কথা যদি বলি, ট্রাম্প গত বছর যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে পরে দুটি টুইটে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এনেছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে কথা বলেছেন। সে কারণেই বলা যায়, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বড় নজর থাকবে। এটা অবশ্য নতুন নয়। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সে সময়ও এমনটা দেখেছি। সে জন্য বলা যায়, ট্রাম্প সেই ধারাবাহিকতাই হয়তো বজায় রাখবেন। 

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার অবাধ, সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতও সম্প্রতি বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পার্টি এখানে নির্বাচিত সরকার দেখতে চাইবে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টি বাংলাদেশের প্রতি যে মনোযোগ দিয়েছিল, ট্রাম্পের সময়ে মনোযোগে ভাটা পড়তে পারে। সে জন্য বাংলাদেশকেই চিন্তাভাবনা করত হবেতাদের সে ধরনের মনোযোগ না থাকলেও কীভাবে সুযোগ-সুবিধা নেওয়া যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে কাঠামো পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, সেখানে তাদের মনোযোগ ধরে রাখতে হলে আমাদেরই হোমওয়ার্ক করতে হবে।

আমরা জানি, ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামোর কথা চিন্তা করছেন। তিনি কানাডা মেক্সিকোর পণ্যে শুল্ক আরোপের কথা ভাবছেন বলে ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বাংলাদেশের পোশাক খাতের বড় বাজার, সেদিক থেকে আমাদের উদ্বেগের কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খাত নেই এবং খাতের বিস্তারের চিন্তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। সেটা যদি তারা করতে চায়, তাতেও বাংলাদেশের পোশাক শিল্প লাভবান হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের যেহেতু পোশাক খাতে বিশেষ দক্ষতা তৈরি হয়েছে, সে দক্ষতা যুক্তরাষ্ট্র কাজে লাগাতে পারে। এমন সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশের উদ্যোগী হতে হবে। 

ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ভাষণে খোলাসা করেছেন, তিনি কোনো যুদ্ধ চান না। তিনিপিস বিল্ডারহিসেবে ভূমিকা পালন করতে চান। তার কিছুটা নমুনা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। তিনি দ্বিতীয় দফায় শপথ নেওয়ার আগেই গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও দেখা দরকার, যুদ্ধবিরতি প্রথম পর্বের পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্বে যায় কিনা। বস্তুত গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে অনেকেই এক ধরনের শঙ্কার মধ্যে আছেন। যেহেতু তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে বড় আকারে চাপ দিয়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে পেরেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তিনি কোনো যুদ্ধে যেতে চাইছেন না। 
ট্রাম্প এটাও মনে করেন, ইউরোপে যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সদিচ্ছা আছে। সংঘাত বন্ধে জেলেনস্কি চুক্তি করতে চান। অর্থাৎ ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও তিনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী। যা হোক, ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন যে শান্তির মনোভাব দেখাচ্ছেন, সেটি অক্ষুণ্ন থাকলে চীনের সঙ্গেও নতুন ধরনের সম্পর্ক সম্ভব। তিনি শি জিন পিংকে তাঁর অভিষেকে আমন্ত্রণ করে এর ইঙ্গিতও দিয়েছেন। চীনা কোম্পানির টিকটক যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল; সেটাও ট্রাম্পের কারণে সেখানে আবার চালু হয়েছে। আমরা তাঁর ব্যবসায়িক ভারসাম্যপূর্ণ একটা বৈশ্বিক সম্পর্ক হয়তো দেখব। যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে এমনটা সম্ভব নয়। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সে ধরনের সম্পর্ক হলে তাতে বাংলাদেশও লাভবান হতে পারে।

বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রোহিঙ্গা। গত বছর নভেম্বরে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল প্রকাশ হয়, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়লাভ করেন, সে সময় সমকালে প্রকাশিত লেখায় আমি বলেছি, রোহিঙ্গা নির্যাতনের ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটরা সোচ্চার ছিল। তারা বার্মা রোহিঙ্গা অ্যাক্ট করেছিল। ট্রাম্পের জয়ে বাংলাদেশের জন্য বার্তা ( নভেম্বর, ২০২৪) 

 বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যু কতখানি গুরুত্ব পাবে, সেটা দেখার বিষয়। কারণ এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়িয়ে গিয়েছিল, সেটা ট্রাম্প তাঁর উপদেষ্টারা পছন্দ করেননি। প্রেসিডেন্ট পদে থেকেও ট্রাম্প সেই জটিলতা পরিহার করতে চাইবেন বলে মনে হয়। তাঁর মেয়াদে মিয়ানমার প্রশ্নে তিনি ভারত চীনের উদ্বেগও আমলে নেবেন বলে মনে হয়। সেই বিবেচনায় রোহিঙ্গা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগে ভাটা পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতি আবার সুযোগের পথও তৈরি করে দিতে পারে। এখানেও আমাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।

অভিবাসন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিতে বাংলাদেশিদের শঙ্কার কারণ নেই। কেউ যদি অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে থাকে, সেটা ভিন্ন বিষয়। ট্রাম্পের নজর মূলত হিস্প্যানিকদের দিকে। কারণ দক্ষিণ আমেরিকা থেকে অবৈধভাবে আসা হিস্প্যানিকদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে গিয়েছিল। সে জন্য ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণ করেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন এবং মেক্সিকো সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশি যারা পড়াশোনা করতে বা অন্যভাবে যায়, তারা বৈধভাবেই যায়। সে কারণে তাদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

বাংলাদেশের এখন উচিত নতুন করে ক্ষমতায় আসা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যোগোযোগ বাড়ানো। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকসহ বহুমুখী সম্পর্ক আছে। এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক কীভাবে বাড়ালে উভয়ের জন্যউইন উইনপরিস্থিতি হতে পারে, সেই হোমওয়ার্কও আমাদের করতে হবে। আশায় থাকা যাবে না যে, আমেরিকা নিজে থেকে এসে রাজনৈতিকভাবে আমাদের সাহায্য করবে। কারণ ট্রাম্প হয়তো অনুভব করছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিষয়ে আমেরিকা যেভাবে হস্তক্ষেপ করে, তাতে দেশটির ওপর থেকে মানুষের আস্থা কমে আসে। সে জন্য কূটনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতিকে ফোকাসে রাখতে হবে। 

একই সঙ্গে যেটা শুরুতেও বলেছি, আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নজর থাকবে। তারা চাইবে বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার আসুক এবং সেই সরকারের সঙ্গে তারা কাজ এগিয়ে নেবে। 

 লেখক: প্রাক্তন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য