clock ,

‘আমরা চাকরি হারানোর ভয়ে ছিলাম’: নী সুন ইস্ট এস্টেটের পরিচ্ছন্নতা কর্মীবৃন্দ

‘আমরা চাকরি হারানোর ভয়ে ছিলাম’: নী সুন ইস্ট এস্টেটের পরিচ্ছন্নতা কর্মীবৃন্দ

ঘটনাটি শুরু হয় এক অজ্ঞাত অভিযোগের মাধ্যমে, যেখানে কেউ একজন জানান যে, নী সুন ইস্ট এস্টেটে কর্মরত অভিবাসী পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা তাদের ম্যানেজারকে ঘুষ দিচ্ছেন। এরপর কয়েক দিনের মধ্যে, সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয় (MOM) প্রায় ২০ জন তদন্ত কর্মকর্তাকে নিয়োগ করে। তারা ৩০ জনের বেশি কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং ম্যানেজার ডেরিক হো চিয়াক হককে গ্রেপ্তার করেন। লিয়ান চেঙ কন্ট্রাক্টিং এর সাবেক অপারেশন ম্যানেজার হো ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৫৭ জন বাংলাদেশি কর্মীর কাছ থেকে তাদের ওয়ার্ক পারমিট নবায়নের নামে ৩৯৬,৪৪০ ডলার ঘুষ নিয়েছিলেন।

লিয়ান চেঙ কন্ট্রাক্টিং এর সাবেক অপারেশন ম্যানেজার হো

৫৫ বছর বয়সী ডেরিক হোকে ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর ২৪ সপ্তাহের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, কারণ তিনি বিদেশি কর্মসংস্থান আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ স্বীকার করেন। MOM এর ফরেন ম্যানপাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের (FMMD) বিভাগীয় পরিচালক মিস্টার অ্যাড্রিয়ান কুয়েক জানান, এটি ছিল ঘুষ গ্রহণ সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় মামলাগুলোর মধ্যে একটি, যা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত তদন্ত করেছে।

জনশক্তি মন্ত্রণালয় এর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৭০ জন নিয়োগকর্তা অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অপরাধে ধরা পড়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে, বাকিরা সতর্কতা নোটিশ বা জরিমানা পেয়েছেন।


মিজ ফেলিসিয়া লিম এবং তার দল, ভুক্তভোগী মোহাম্মদ হানিফ (বাঁয়ে) এবং লুৎফর রহমান

২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি, MOM এর FMMD এর সহকারী তদন্ত পরিচালক এবং ডেরিক হো মামলার প্রধান তদন্তকারী ফেলিসিয়া লিম The Straits Timesকে বলেন, ২০২০ সালের নভেম্বর পাওয়া অভিযোগে দুজন ভুক্তভোগী কর্মীর নাম উল্লেখ ছিল। MOM এর তদন্তকারীরা ডেরিক হো যেন কোনোভাবেই জানতে না পারেন, সেজন্য রাত ১০টার পরে ওই কর্মীদের তাদের কর্মস্থল থেকে গোপনে নিয়ে যান এবং বেন্ডেমিয়ার রোডের MOM পরিষেবা কেন্দ্রে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। প্রাথমিকভাবে, কর্মীরা ভীত ছিলেন যে হো জানতে পারলে তারা চাকরি হারাতে পারেন। ফেলিসিয়া লিম বলেন, “আমরা তাদের আশ্বস্ত করি যে যদি তাদের অভিযোগ সত্য হয়, তবে যারা দোষী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর, MOM কর্মকর্তারা নী সুন ইস্ট এবং পাশির রিজ পুংগোল এস্টেটে অভিযান চালান। সেখানে ডেরিক হো এর অধীনে থাকা সব পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর, ডেরিক হো এবং তার সঙ্গে ঘুষ সংগ্রহকারী বিদেশি সুপারভাইজারদের গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময়, তারা স্বীকার করেন যে তারা দীর্ঘদিন ধরে কর্মীদের কাছ থেকে ঘুষ নিচ্ছিলেন।

তদন্তকারীরা সেই দিনই ডেরিক হো এর বাড়িতে অভিযান চালান। তাদের কাছে থাকা অন্যতম শক্তিশালী প্রমাণ ছিল একটি ছবি, যেখানে এক বিদেশি সুপারভাইজারের মোবাইলে টাকা বাঁধার একটি ছবি পাওয়া যায়। অভিযানের সময়, ঠিক সেই বান্ডিলটিই পাওয়া যায় হো এর বাড়ির সেফে রাখা টাকার স্তূপের ওপর। সেখানে মোট ৩২৬,৩০৫ নগদ ডলার ছিল। ফেলিসিয়া লিম বলেন, আমি খুশি ছিলাম যে টাকা এখনো অক্ষত ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে সে যে এত বিশাল পরিমাণ নগদ অর্থ ঘরে রেখে দিয়েছিল দেখে অবাকও হয়েছিলাম। তদন্তকারীরা একটি লগ শিটও খুঁজে পান, যেখানে সে ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫৭ জন কর্মীর কাছ থেকে নেওয়া টাকা লিপিবদ্ধ করেছিল। গ্রেপ্তারের সময়, হো তার স্ত্রী যেন হাতকড়া দেখতে না পারেন, সে অনুরোধ করে। তার হাত পেছনে বাঁধা ছিল, তাই ফেলিসিয়া লিম তাকে একটি জ্যাকেট দেন হাতকড়া ঢেকে রাখার জন্য।

MOM কর্মকর্তারা এরপর কোম্পানির পরিচালক অন্যান্য এস্টেটে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন তারা এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না নিশ্চিত হতে। ডেরিক হো এবং তার প্রাক্তন সহকর্মী রাকিবুল ২০১৪ সালে এই প্রতারণামূলক স্কিম চালু করেন। তারা এক বছরের কর্মসংস্থান পাস নবায়নের জন্য ,৫০০ এবং দুই বছরের জন্য ,০০০ ডলার আদায় করত। এর মধ্যে হো কর্মী প্রতি নবায়নে ,০০০ এবং ,০০০ নিজের কাছে রেখে দিত, আর রাকিবুল বাকি অংশ নিত।

নী সুন ইস্ট টাউন কাউন্সিলে পরিচ্ছন্নতা কর্মী ৩৭ বছর বয়সী লুৎফর রাহমান চার বছরে হো কে ,০০০ ঘুষ দেন। এই টাকার জন্য তিনি নিজের সমস্ত সঞ্চয় শেষ করে ফেলেন এবং সহকর্মীদের কাছ থেকেও ধার নেন। তিনি বাংলাদেশে তার স্ত্রী এবং ১০ ১২ বছর বয়সী দুই ছেলের জন্য একটি বড় বাড়ি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ঘুষ দেওয়া যে অবৈধ, তা জানার পরও রহমান ডেরিক হোকে অমান্য করতে ভয় পেয়েছিলেন। একজন দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলার সময় রহমান বলেন, আমি ভয় পেতাম যে যদি বলি আমি টাকা দিতে চাই না, তাহলে আমাকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে এবং চাকরি হারাব।

রহমান ,২০০ বেতনে কাজ করতেন এবং এই টাকার বেশিরভাগ অংশ ঋণ শোধ করতে ব্যয় করতেন। তিনি মাসিক খরচ ৩০০ থেকে কমিয়ে ২০০ করেন। তিনি বলেন, যখন কিছু খেতে ইচ্ছা হতো, তখন ভাবতাম খেতে হবে না, টাকা বাঁচাতে হবে।

আরেকজন ভুক্তভোগী হানিফ মোহাম্মদ বলেন, চার বছরে হো কে ,৬০০ ডলার ঘুষ দেন, কিন্তু তিনি জানতেন না যে এটি অবৈধ। তিনি বলেন, হো দাবি করেছিলেন এটি কোম্পানির নিয়ম, এমনকি তাকেঅভিজ্ঞ কর্মীহিসেবে একটি বিশেষছাড়দেওয়ার কথাও বলেন। ,২০০ ডলার মাসিক বেতনে কাজ করা হানিফ দুই বছরের ওয়ার্ক পারমিট নবায়নের জন্য ,০০০ পরিবর্তে ,০০০ দিতে বাধ্য হন। হানিফের দেশে সাত বছর বয়সী ছেলে এবং দুই বছর বয়সী মেয়ে রয়েছে। তিনি পরিবারকে এই বিষয়ে কিছুই জানাননি। তিনি বলেন, যদি আমি এখানে টাকা হারাই বা অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাহলে আমার পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে।

ফেলিসিয়া লিম বলেন, ডেরিক হো অনুতপ্ত ছিলেন এবং জেলে যাওয়ার আগে তার আইনজীবীদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত দেন। যখন শ্রমিকরা তাদের টাকা ফেরত পাওয়ার কথা বলছিলেন, তখন তাদের মুখে হাসি ছিল। রহমান এখন একটি নির্মাণ কোম্পানিতে লরি চালক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, যখন আমরা এই টাকা দিয়েছিলাম, তখন কখনোই ভাবিনি যে এটি ফিরে পাবো। অবশেষে নতুন বাড়ির জন্য এখন থেকে সঞ্চয় শুরু করতে পারব। অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ÔTransient Workers Count TooÕ (TWC2) এর নির্বাহী পরিচালক ইথান গুও জানান, অভিবাসী শ্রমিকরা সহজেই শোষণের শিকার হন, কারণ সিঙ্গাপুরে চাকরি পেতে তারা সাধারণত বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা বহন করেন। তারা তাদের জমি বিক্রি করে, স্ত্রীর গহনা বন্ধক রাখে। চাকরি ধরে রাখতে তারা যেকোনো কিছু করতে রাজি, আর পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবাই জানে যে শ্রমিকদের হারানোর মতো অনেক কিছু আছে। TWC2 ২০১৯ সালে সাতটি, ২০২০ সালে ১১টি ঘুষ সংক্রান্ত মামলা পেয়েছিল। বর্তমানে সংগঠনটি প্রতি বছর গড়ে দুইটি মামলা পাচ্ছে, তবে গুও মনে করেন যে সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে কর্মীরা কোভিড-১৯ মহামারির পর চাকরি হারানোর ভয়ে কথা বলছেন না।

NTUC এর 'Migrant WorkersÕ Centre' এর নির্বাহী পরিচালক মাইকেল লিম বলেন, গত পাঁচ বছরে ঘুষ সংক্রান্ত ঘটনার সংখ্যা কমে গেছে। তিনি জানান, জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে, যেমন নিয়োগকর্তাদের বিস্তারিত বেতনের হিসাব সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা।

MOM জানিয়েছে যে তারা অভিবাসী শ্রমিকদের ঘুষ সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন করে এবং কিভাবে এই ধরনের ঘটনা রিপোর্ট করতে হয়, সে বিষয়ে শিক্ষা দেয়। এছাড়া, তাদের আশ্বস্ত করা হয় যে যদি অভিযোগ সত্য হয়, তবে তারা অন্য চাকরি খুঁজে নিতে পারবেন। জনশক্তি মন্ত্রণালয় ডাটা অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে, যাতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিক ধরণ চিহ্নিত করা যায় এবং ঘুষ সংক্রান্ত ঘটনা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। গুও বলেন, বেশিরভাগ শ্রমিক TWC2 কে জানিয়েছেন যে তারা সিঙ্গাপুরে কাজ করতে এসেছেন, কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে এখানে ভালো আইন রয়েছে এবং তারা শোষণের শিকার হবেন না। তিনি আরও বলেন, যদি ঘুষ নেওয়ার ঘটনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে শ্রমিকরা হয়তো সিঙ্গাপুরে কাজ করতে আগ্রহী থাকবে না। একই সঙ্গে, যারা supply chain পরিষ্কার রাখতে চায়, তারা হয়তো আর এখানে বিনিয়োগ করবে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, আমরা ধরে নিচ্ছি যে সিঙ্গাপুরে সর্বদা কম খরচে শ্রমিক আসবে। কিন্তু এটি সবসময় সম্ভব হবে না। আমাদের উচিত শ্রমিকদের অবহেলা না করা।

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য