গত ৪ ফেব্রুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে ৩৮ বছর বয়সে অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন রুবেল (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন )। ২০২২ সালে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ফজলে ইলাহী,চিকিৎসার পরেও যখন ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তখন তিনি দেশে ফিরে যান।
বন্ধু ও কাছের মানুষের কাছে রুবেল ছিল একটি অনুপ্রেরণার নাম। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণকারী রুবেল প্রথম সিঙ্গাপুরে আসেন ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ২০১৫ সালে তিনি কিছু বে-সরকারি সংস্থার (এনজিও) সাথে পরিচিত হওয়ার পর সমাজকর্মে অংশ নিতে শুরু করেন। তার প্রথম ধারণা ছিল,যা তিনি তার গ্রামের কলেজে পড়াকালীন সময় শুরু করেছিলেন, সেই কার্যক্রমের কিছুটা সিঙ্গাপুরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা এবং সেইভাবেই ২০১৭ সালে মাইগ্রেন্ট লাইব্রেরি সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে মাইগ্র্যান্ট কালচারাল শো চালু করেন।
সিঙ্গাপুর ছাড়ার আগে চ্যানেল নিউজ এশিয়ার প্রতিবেদকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রুবেল বলেছিলেন, তিনি একদিন আবার ফিরে আসার আশা করেন এবং এমন একটি দেশ খুঁজে পাবেন যা আগের চেয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের আরও ভালোভাবে সম্মান করতে শিখেছে। তিনি বলেন, আমি কখনই ভুলবো না তাদের, যারা কঠিন সময়ে তাকে সাহায্য করেছিলেন, যেমন কাজের পর কেমোথেরাপি সেশন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। এই শহর এবং এই মানুষরা আমাকে ভালোবাসে, ঠিকএকইভাবে,আমি এই শহর এবং এই মানুষদের ভালোবাসি।
মিঃ ফজলে ইলাহীর গল্পটি সিঙ্গাপুরের জনগণের কাছে এক অনুপ্রেরণার গল্প। ভারতে চিকিৎসার জন্য তহবিল সংগ্রহে অনেকে সাহায্য করেছেন এবং তাকে অতিরিক্ত অর্থও প্রদান করেছেন, যাতে তিনি জীবনের শেষ সময় পরিবারের সদস্যদের সাথে কাটাতে পারেন।
প্রাক্তন মনোনীত সংসদ সদস্য আন্তিয়া অঙ বলেন, আমি কৃতজ্ঞ যে সিঙ্গাপুরে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ তাকে তার পরিবার, বিশেষ করে তার ছেলে রিহান, সাথে শেষ ১৮ মাস কাটানোর সুযোগ দিয়েছে। তিনি রিহানের জন্য বাঁচতে চেয়েছিলেন। ২০১৭ সালের দিকে রুবেলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি বলেন, রুবেল ক্রিটিকেয়ার ফান্ড ফর মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারস'কে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সিঙ্গাপুর এবং অভিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি তার ভালোবাসার অবদান এই তহবিলের বৃদ্ধি এবং বহু মানুষের জীবনে প্রতিফলিত হবে যারা আগামী বছরগুলোতে প্রভাবিত হবে।
আক জিলানি, যিনি ফজলের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বলেছেন, তিনি ফজলেকে তার ভাইদের একজন হিসাবে দেখতেন। তিনি বলেন, রুবেলএকজন আনন্দিত মানুষ, খুব সাহসী এবং যাদের আমি কখনো জানতাম তাদের মধ্যে অন্যতম সবচেয়ে দয়ালু হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। আমি খুবই লাজুক, খুবই চুপচাপ ছিলাম... তার সাথে পরিচিত হওয়ার পর, আমি একটি সম্প্রদায় তৈরি করলাম, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হলাম...কোভিড-১৯ মহামারীর সময়, তিনি অনেক শ্রমিককে, অনেক ডরমিটরিকে সাহায্য করেছিলেন।
মাইগ্রান্ট কালচারাল শো-এর সংগঠক কমিটির সদস্য মিস ইউলিয়াতুন সুরাজি বলেছেন, মিঃ ফজলে ছিলেন "বিশেষ মানুষ" এবং অভিবাসী শ্রমিকদের "সুপ্ত প্রতিভা" প্রচারের জন্য অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। আমি ৭ বছর যাবত তাকে চিনি, কখনোই তার মতো কাউকে দেখিনি। তিনি সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে অভিবাসী শ্রমিকরা সিঙ্গাপুরে বড় বড় অবদান রেখেছে। ফজলে বিভিন্ন অভিবাসী ভাইবোনদের কাছে অনেক শ্রদ্ধার এবং ভালোবাসার ব্যক্তি ছিলেন।
তিনি সিঙ্গাপুরকে খুব ভালোবাসতেন এবং আমার সাথে তার একটি স্বপ্ন শেয়ার করেছিলেন, তা হলো তিনি প্রথম অভিবাসী শ্রমিক হতে চান যিনি একজন স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হবেন, যাতে তিনি পিআর (স্থায়ী বাসিন্দা) আবেদন করতে পারেন এবং হয়তো পরবর্তীতে (নাগরিকত্ব) অর্জন করতে পারেন। ফজলে একটি বিএসএ ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেছিলেন এবং একটি কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি প্রোগ্রামের দুটি সেমিস্টার শেষ করেছিলেন। তিনি প্রতিটি সেমিস্টারে তার উপস্থিতি এবং ফলাফল আমার সাথে শেয়ার করতেন। তিনি ভাল করেছিলেন এবং কেমোথেরাপি এবং কাজের পরেও তার উপস্থিতি ১০০ শতাংশ ছিল।
জিলানি বলেন,তিনি অভিবাসী সম্প্রদায়কে আশা দিয়েছেন যে, আমরা সংগঠক হতে পারি। আমরা আমাদের নিজেদের নেতা হতে পারি। আমাদের অন্যদের ওপর নির্ভর করতে হবে না। আমরা নিজেরাও নিজেদের উঁচুতে তুলে নিতে পারি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন রুবেল। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন, তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন দেশি –বিদেশি সুহৃদ,শুভাকাঙ্খীরা।
ড. মশিউর রহমান লিখেছেন,রুবেল ভাইয়ের সাথে মাঝেমধ্যে ক্যামেরায় এবং ভিডিও নিয়ে কথা হত। ফটোগ্রাফি নিয়ে ছিল উনার অনেক আগ্রহ। দুজনে মিলেও অনেক সময় আমরা ফটো শুটিং করেছি বিভিন্ন ইভেন্ট গুলোতে। এভাবে যে হঠাৎ করে চলে যাবেন তা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর।
ফাহিমা কানিজ লাভা লিখেছেন, ভালো মানুষ ছিলেন, পরোপকারী মানুষ ছিলেন ভাই। আমাদের পাঠাগারে নানা সময়ে সহযোগিতা করেছেন,পরামর্শ দিয়েছেন। তাকে আমরা মনে রাখব।
Jenelyn Alegonero Leyble লিখেছেন, Rest in peace brother, thank you for all your contributions in literary and cultural industry here in Singapore!You maybe gone but never forgotten!Condolences to the bereaved family!Thank you for being such a an inspiration to all migrants!
Ravi Singaram লিখেছেন, Miss you Rubel, thank you so much for your honest interview with us before you left Singapore and for brightening up the lives of so many.
Desy DK লিখেছেন, Your legacy for migrants community will remain, rest in jannah peacefully bro. Your soul may gone but stories will always stay.
Sheikh Muslima Moonলিখেছেন, গভীর শোকাহত। এত ভালো ছিল... আমরা ওর কাছে অনেক ঋণী।
রুবেল সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ সোসাইটির একজিন সক্রিয় সমর্থনকারী ছিলেন। সংগঠনের পক্ষ থেকেও রুবেলের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। ফজলে ইলাহী রুবেল সিঙ্গাপুরে তাঁর অভিবাসী জীবনের শুরু থেকে অনেক প্রভাবশালী উদ্যোগ নিয়েছিলেন,এবং তার জীবনের সংগ্রাম এবং অবদান অনেকের জন্য একটি শক্তি ও অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
ফজলে ইলাহী রুবেল এমন একজন মানুষ, যিনি শুধু তার জন্য নয়,পুরো সমাজের জন্য কাজ করেছেন।
বাংলার কণ্ঠ পরিবারের পক্ষ থেকে রুবেলের বিদেশি আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?