বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। অনেকে আশা করেছিলেন, শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর এই ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার ছয় মাস পরও বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ের বিচারবহির্ভূত হত্যার এক আলোচিত ঘটনা কুমিল্লার যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যু।
তৌহিদুল ইসলাম, পেশায় চাকরিজীবী, কুমিল্লার বাসিন্দা হলেও চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। বাবার মৃত্যুর কারণে তিনি কুলখানির জন্য কুমিল্লায় আসেন। কিন্তু সেই রাতেই যৌথবাহিনীর অভিযানে তাকে বাসা থেকে আটক করা হয়।তার ভাই সাদিকুর রহমান জানান- "রাত আড়াইটার দিকে সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢোকে। সঙ্গে সিভিল পোশাকের লোকজনও ছিল। তারা আমার ভাইকে খুঁজতে থাকে। সামনে আসার পর তারা বলে, ‘অস্ত্র কোথায়?’ আমার ভাই বললো, ‘আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই।’"কিন্তু যৌথবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রের খোঁজে তল্লাশি চালান এবং অস্ত্র না পেয়ে তাকে তুলে নিয়ে যান। সাদিকুর বলেন—"যারা নিয়ে গেছে, তারা ওকে যতক্ষণ নিঃশ্বাস ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত পিটিয়েছে। সকালে পুলিশ থেকে ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলে। সেখানে গিয়ে দেখি, ভাইয়ের কোনো নড়াচড়া নেই। ডাক্তার জানালেন, সে তো আগেই মারা গেছে।"
তৌহিদুলকে আটক করার সময় একই রাতে একই গ্রাম থেকে লুৎফর নামের আরও একজনকে আটক করা হয়। তবে কয়েক ঘণ্টা পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। লুৎফর জানান—"আমাকে চোখ বেঁধে গাড়িতে রেখেছিল। তৌহিদকে নামিয়ে একটু দূরে নিয়ে পেটাচ্ছিল। আমি তার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। সে শুধু বলছিল, ‘আমাকে কেন মারছেন? আমি তো কিছু করিনি।’" তৌহিদুল বারবার বলছিলেন তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু যৌথবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র বের না করলে আরও মারধর করা হবে বলে হুমকি দেয়।
তৌহিদুলের পরিবার অভিযোগ করছে, স্থানীয় কোনো প্রতিপক্ষ যৌথবাহিনীর কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাকে ফাঁসিয়েছে। তবে তৌহিদুলের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার জানিয়েছেন,"এই ঘটনার পর সেনাবাহিনী থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা আশ্বাস দিয়েছেন, তদন্তের পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।" সেনাসদর থেকেও জানানো হয়েছে তদন্ত চলছে।
শুধু যৌথবাহিনী বা পুলিশের হেফাজতে নয়, গণপিটুনিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাও বেড়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে গণপিটুনিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লা মারা যান। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ থাকলেও পরিবারের প্রশ্ন— কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?তার বাবা ইয়াজউদ্দিন মোল্লা বলেন—"ওকে পুলিশের কাছে না দিয়ে সবাই মেরে ফেললো। ছেলেটা পানি চেয়েছিল, তাও দেয়নি।"
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মতে—২০২৪ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে ২১টি মৃত্যু ঘটেছে।শুধু সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই ১২টি ঘটনা ঘটেছে।এর মধ্যে ৭টি যৌথবাহিনীর অধীনে, ৩টি পুলিশের হেফাজতে।গত সেপ্টেম্বরে গাইবান্ধায় যৌথবাহিনীর অভিযানে আওয়ামী লীগ নেতাসহ পাঁচজন আটক হন। এই ঘটনাও ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নতুন সরকারের কাছে আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষার প্রত্যাশা ছিল অনেকের। কিন্তু ছয় মাস পর দেখা যাচ্ছে— যৌথবাহিনীর হাতে আটক থাকার পর মৃত্যু হচ্ছে। গণপিটুনিতে বিচারবহির্ভূত হত্যা বাড়ছে।নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বন্ধ হয়নি। ফলে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে— বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি কি আদৌ বদলাবে?
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?