অবৈধ পন্থায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথে সর্বপ্রথম সক্রিয় হয় শিক্ষার্থী সমাজ; গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে। তবে আন্দোলনটি স্রেফ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছিল না। ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ওই আন্দোলনের তিনটি দাবি ছিল– এক. মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল; দুই. সব ছাত্র ও রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তিদান; তিন. সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
১৯৮৩
সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের
ঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি চালায়। এতে জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, কাঞ্চন, দিপালীসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী
নিহত হন। তখন থেকে
দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর দিবসটি পালনকালে
কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হওয়া দরকার
স্বৈরাচার প্রতিরোধের স্থায়ী পথ ও পদ্ধতি।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র গঠনের ‘আদিপাপ’ মীমাংসা না করেই আওয়ামী
লীগের একক ইচ্ছায় সংবিধান
প্রণীত হয়েছিল। কী সেই ‘আদিপাপ’?
স্বাধীন দেশের জন্য নতুন সংবিধান
সভা নির্বাচনের (গণপরিষদ) মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সংবিধান প্রণয়ন না করা। ফলে
দলীয় অনুগত আইনপ্রণেতাদের মাধ্যমে এক ব্যক্তির হাতে
সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকারী সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, যারা আসলে পাকিস্তান
রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে
তৎকালীন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সংবিধান সভা এবং জনতার
সম্মতির ভিত্তিতে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারী
ক্ষমতা বন্দোবস্তের সংবিধান পাল্টানোর দ্বিতীয় সুযোগ এসেছিল ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের
সময়ে। আন্দোলনকারী কোনো কোনো পক্ষ
থেকে তেমন আলাপও উঠেছিল।
কিন্তু সেই আলাপ, দাবি
ও গণঅভ্যুত্থানকে স্রেফ ‘সাংবিধানিক ক্ষমতা হস্তান্তরের ধারাবাহিকতা’র দিকে নিয়ে
গিয়েছিল তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী জোট। পরবর্তী রাজনীতিতে
সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পুনর্বাসন ঘটেছিল এসব দলের হাতেই।
কেবল পুর্নবাসন নয়; নির্বাচনী রাজনীতির
অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হতে পেরেছিলেন। পতিত
সামরিক স্বৈরাচার হয়ে উঠেছিলেন ‘গণতন্ত্রের
শোভা’। এসব রাজনৈতিক
দলই আজতক আমাদের গণতন্ত্রের
‘মাস্টার’ হয়ে বসে আছে।
তাদের গণতান্ত্রিক বুলির আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে
রাষ্ট্র গঠনের ‘আদিপাপ’ শোধরানোর জরুরত ও দাবি।
বাংলাদেশের
মানুষের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-প্রতিরোধ গড়ে
তোলার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন রাষ্ট্রেও তারা নাগরিক অভ্যুত্থানের
মাধ্যমে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু
জনতার বীরোচিত উত্থানকে অর্থবহ করতে একটি ন্যূনতম
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের দায় রাজনৈতিক দলগুলোর
পালন করেনি। বরং এরশাদকে ভোটের
রাজনীতির পুতুলে পরিণত করেছিল। ফলে দেশ থেকে
স্বৈরাচার যায়; কিন্তু নানা
মোড়কে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র থেকেই যায়।
ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ
ভেবেছিল, আইয়ুব-ইয়াহিয়াকে হটানো গেছে; এরশাদকেও উৎখাত করা গেছে। এবার
‘গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঁচ বছর অন্তর
নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসালেই গণতন্ত্র নিশ্চিত হবে।
বাস্তবে
গণতন্ত্রের ধারণাকে নির্বাচনে সংকুচিত করা নব্বই-উত্তর
রাজনৈতিক ডিসকোর্সের প্রধান সীমাবদ্ধতা। কোনো রাষ্ট্রের ক্ষমতাবিন্যাস
যদি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক না হয়, তাহলে
নির্বাচন তেমন কাজে আসে
না; বরং নির্বাচনের মাধ্যমে
‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ কায়েম হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক
ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে এই বোঝাপড়া বরাবরই
অনুপস্থিত ছিল এবং আছে।
নাগরিকের কাছে যদি কিছুই
না থাকে; নিজের বাছাই করা প্রতিনিধি যদি
তার জীবন-মৃত্যুর প্রভু
হয়ে ওঠে, তাহলে শুধু
নির্বাচনী ব্যবস্থা নির্মম পরিহাস মাত্র। গত ১৫ বছর
সেই নামকাওয়াস্তে নির্বাচনী ব্যবস্থাই ছিল না। এতে
প্রতীয়মান, রাষ্ট্র কাঠামো গণতান্ত্রিক না হলে এমনকি
সুষ্ঠু নির্বাচনটুকুও বহাল রাখতে সক্ষম
হয় না।
শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ‘গণতন্ত্র’ বলে প্রচারের সংকট
উন্মোচনের দায়িত্ব ছিল বুদ্ধিজীবীদের। অথচ
বুদ্ধিজীবীরা গত ১৫ বছর
সুষ্ঠু নির্বাচনের বিরোধিতা করেছেন; এখন গণতান্ত্রিক সংস্কারের
প্রশ্ন এড়িয়ে স্রেফ নির্বাচনের দাবিকে সমর্থন জানাচ্ছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় যে কোনো স্বৈরাচারবিরোধী,
গণতন্ত্রমনা ও কর্তৃত্ববিরোধী মানুষের
আসলে ‘মহান’ দোহাই আর সাইনবোর্ডের আড়ালে
ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরতান্ত্রিক
ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই।
বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের
পক্ষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রধান কর্তব্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক
অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণের
লড়াই গড়ে তোলা।
গণঅভ্যুত্থানের
মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটেছে ঠিকই;
রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা এখনও বহাল। এমন
সময়ে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান
থেকে শিক্ষা কী? শিক্ষা এটাই–
নির্দিষ্ট স্বৈরাচারী রেজিমের পতন ঘটা মানেই
স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটা নয়।
নির্বাচন মাত্রই গণতন্ত্র নয়। স্বৈরতন্ত্র থেকে
যাওয়ার মতো ক্ষমতা কাঠামো
বদলানোর দিশা খোঁজার কোনো
বিকল্প বর্তমানে নেই।
মনে রাখা জরুরি, গঠনতান্ত্রিক
সংকটই বাংলাদেশের প্রধান সংকট। একে পাশ কাটিয়ে
আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
স্বাধীনতার পরপরই প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো বহাল রেখে বাদবাকি
সব প্রগতিশীল আকাঙ্ক্ষা আসলে কোনো কাজেই
আসবে না। ৫০ বছর
ধরে একটি শাসনতান্ত্রিক সংকট
তৈরি করে রেখে গোটা
দেশকে নানা মতাদর্শে বিভক্ত
করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে সক্রিয়তার কোনো বিকল্প নেই।
রাষ্ট্রকর্মের সীমা নির্ধারণ করা
প্রয়োজন। সংবিধান যে নিরঙ্কুশ স্বৈরতান্ত্রিক
হওয়ার সুযোগ করে দেয় ক্ষমতাসীন
দলকে, তা বন্ধ করতে
হলে সাংবিধানিক সংস্কার করা সময়ের দাবি।
কোনো দলের ক্ষমতায় থাকা
না-থাকাকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সমার্থক করে দেখানোর দলবাজ
বুদ্ধিবৃত্তিক শঠতার বিরুদ্ধে গণমুখী বুদ্ধিজীবিতা তৈরি করা প্রয়োজন।
রাষ্ট্র
প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দেবে। থাকবে জনগণের অধীন। পাশাপাশি সমাজে নানাবিধ স্বাধীন উদ্যোগ ও সক্রিয়তা থাকবে।
ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীনতাকে
নিঃশর্ত ধরে আইন ও
ক্ষমতা কাঠামোর বিন্যাস তৈরি করতে হবে।
নাগরিককে আইনত জুলুম-নিপীড়ন
করার ঔপনিবেশিক মডেলের আইনের সাপেক্ষে মৌলিক অধিকারকে বিচার করা যাবে না।
সমাজের দ্বন্দ্বগুলোর শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পথ থাকতে হবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী এবং গণক্ষমতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ
ছাড়া বাংলাদেশের সংকট কাটবে না।
বাংলাদেশের মানুষের মানবিক মর্যাদা ও নাগরিক অধিকার
প্রতিষ্ঠার রাজনীতি গড়ে তোলার চেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ কোনো রাজনীতি এ
মুহূর্তে নেই। রাষ্ট্র সংস্কারের
সামাজিক বাসনাকে রাজনৈতিক ভাষা ও সাংগঠনিক
রূপ দেওয়ারই অপর নাম গণরাজনৈতিক
ধারা। এ রাজনৈতিক ধারা
নির্বাচনবিমুখ নয়; কিন্তু নির্বাচনবাদী
রাজনীতির চেয়ে মৌলিকভাবে আলাদা।
চব্বিশের প্রজন্মের সামনে ৯০-এর ভুল
সংশোধনের ঐতিহাসিক মওকা হাজির হয়েছে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক রেখে
শুধু ব্যক্তির পরিবর্তনে জনগণের ভাগ্যের মৌলিক পরিবর্তন হয় না। স্বৈরাচারকে
অবশ্যই বিদায় নিতে হবে; পাশাপাশি
স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রে রূপান্তরের রাজনীতি গ্রহণ করতে হবে।
নব্বইয়ে তিন জোটের রূপরেখা স্বৈরতন্ত্রকে ব্যবস্থা আকারে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাত বদল করাকে ‘গণতন্ত্র’ ভেবে ভুল করেছিল নব্বইয়ের প্রজন্ম। চব্বিশের প্রজন্ম স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করবে– জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তেমন সম্ভাবনা হাজির করেছে। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে গণপরিষদ তথা সংবিধান সভা নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যমান সংবিধানই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধাত্রী। গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান গ্রহণ করাই হতে পারে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষেধক।
লেখক: যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?