clock ,

  ব্রেকিং নিউজ
clock
সমস্যা সমুদ্র সমান, আলো আসবেই

সমস্যা সমুদ্র সমান, আলো আসবেই

দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খাতে ধীরে ধীরে গতি ফিরছে। এর মধ্যে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর অর্থনীতির কয়েকটি সূচকে ইতিবাচক ধারায় চলে এসেছে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এর পরেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে রপ্তানি আয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিও ওঠা—নামার মধ্যে রয়েছে। তবে সামনের দিনে কমবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। খাদের কিনারে থাকা অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। পাশাপাশি অস্থির ডলারের বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও কমার দিকে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের নাজুক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বস্তির দিকে আসছে। তবে নিত্যপণ্যের বাজারে এখনো অস্বস্তি চলমান। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বেসামাল কাঁচাবাজার। দামের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা নিম্ন আয়ের মানুষ। পেঁয়াজ থেকে শুরু করে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, আলু কিনতে ভোক্তাকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৬টি অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কর কমানো সহ বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবুও সুফল আসেনি। তবে শীত মৌসুম শুরু হওয়া সবজির বাজারে ধীরে ধীরে দাম কমে আসছে। 

পাচারে ফোকলা দেশের অর্থনীতি। প্রবাসীরা ঘামঝরা কষ্টের আয় দেশে পাঠান ঠিকই, কিন্তু সব সুযোগ—সুবিধা নিয়ে চুরি ও লুটপাট করে দেশের টাকায় বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করেন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ লুটেরারা। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার বদলে এই পাচারকারীচক্র দেশ থেকে অন্তত ১৭ লাখ কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় দেশের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পাশাপাশি দুবাইও এখন বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের ‘হাব’ হয়ে উঠছে। ক্ষমতার পালাবদলে নতুন সরকার এলেও এখনও ধরাছেঁায়ার বাইরে পাচারকারী রুই—কাতলারা। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার পর পাচারের টাকা ফেরানোর দাবি জোরালো হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী তার যে যোগাযোগ, সেটি কাজে লাগিয়ে তিনি চাইলে বিপুল অঙ্কের ওই পাচারের টাকা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন। অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে দেশ পুনর্গঠনের জন্য এই টাকা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। পাচারের টাকা ফেরানো সময়সাপেক্ষ হলেও তা সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদ—ব্যাংকাররা আশা প্রকাশ করেন। তাদের ধারণা, আগের সরকারের রাজনৈতিক প্রভাবে থাকা ব্যাংকগুলোর মদদেই মূলত টাকা পাচার হয়েছে। এ ছাড়া অনেক ব্যাংকের নজরদারির ঘাটতিও এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। তবে টাকা ফেরানো সময়সাপেক্ষ হলেও সরকার তা ফেরাতে ঠিক পথেই আছে। কোনো কোনো অর্থনীতি বিশ্লেষক মনে করেন, টাকা ফেরানো প্রায় অসম্ভব। যদি দ্বিপক্ষীয় উপায়ে সরকার টু সরকার চেষ্টা করে সফল হয়, তখন হয়তো কিছু টাকা ফেরত আসতে পারে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের পরিসর আরও অনেক দূর। স্বৈরাচারী শক্তির নানান ষড়যন্ত্র রুখতে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা গত ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিন অতিক্রম করলাম। আপনারা জানেন কী কঠিন এক পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। ছাত্র—শ্রমিক—জনতার অভূতপূর্ব গণ—অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান পালিয়ে গেলে দেশ সরকারশূন্য হয় সাময়িকভাবে। পুলিশ প্রশাসনও এ সময় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে উদ্বেগজনক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত এই দেশকে আমাদের সবাইকে মিলে পুনর্গঠন করতে হচ্ছে। হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত চাইব, শুধু জুলাই—আগস্ট হত্যাকাণ্ডই নয়, তাদের সব অপকর্মের বিচার করব। পতিত শক্তি ড. ইউনূসকে নানা ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ করতে চায়। কেবল ষড়যন্ত্র নয়, আরও নানান যন্ত্রের ফেরে পড়ে গেছেন ডক্টর ইউনূস। ছাত্রনেতাদের বড় অংশ যাদের তিনি ক্ষমতার পাটাতন বলেছিলেন তারাও এখন ক্ষমতার অংশীদারত্ব চেয়ে আরেকটা যান্ত্রিকতায় ফেলেছেন তাকে। তারা এখন অন্য উপদেষ্টাদের বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন! আরেক দিকে, সরকারের ভেতর দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার লোভ ঢুকে পড়েছে বলে অভিযোগ ছুঁড়ছে আন্দোলনের কিছু কিছু অংশীজনও। সরকারের কার্যক্রম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৈরি হওয়া সন্দেহ গণ—অভ্যুত্থানের চাওয়ার বাইরে কিছু ইস্যু এনে সরকারের বোঝা ভারী করে দিচ্ছে। জুলাই—আগস্ট বিপ্লবের পর আমরা এমন একটি দেশ হাতে পেয়েছি যার সর্বত্র ছিল বিশৃঙ্খলা। স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসব ছাপিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচন সবচেয়ে জরুরি। তাদের কথার জবাবও দিতে হচ্ছে ড. ইউনূসকে। প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার শেষে নির্বাচন আয়োজন করার কথা আবার জানিয়েছেন তিনি। তাঁর ভাষায়, নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। যদিও সংস্কারের জন্য নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্ব করা যেতে পারে। তবে যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এ ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পেঁৗছাবে, তা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা তার সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ড. ইউনূস আশা করেন, ডিসেম্বর—জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করতে পারবে। তাদের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ক্রমাগতভাবে আলোচনায় সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তারা সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করবেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হওয়া ছাত্র সমন্বয়কেরা বয়সে তরুণ, রাজনীতির নানা ঘোরপ্যাঁচ, ঘাত—প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ না আসায় তাঁদের আবেগ্রাশ্রয়ী নানা সিদ্ধান্ত সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি করছে। নিজেদের আসল রূপের ওপর একটা আলখাল্লা পড়ে আছে সুবিধাবাদী মতলববাজ গোষ্ঠী। মহাপরাক্রমশালী হিসেবে নিজেদের সক্ষমতা ও সামর্থ্য প্রমাণে মাঠে নেমেছে বিএনপি। দেশের এখানে—সেখানে নানা স্থানে আওয়ামী লীগ ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের ছেড়ে যাওয়া চাঁদাবাজির উর্বর ক্ষেত্রগুলোয় দখল কায়েম করে ফেলেছে সামনে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখা দলটির দুবৃর্ত্তরা।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স বেশি নয়। সুতরাং তার ফল এখনই আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারব, তা হয়তো সঠিক প্রত্যাশা হবে না। আমরা মনে করি, জনগণ আর কোনো দখলদার বা স্বৈরাচারের রাজত্ব চায় না। কিন্তু নানাভাবে সর্বত্র নতুন দখলদারদের ক্ষমতা কাঠামো গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। হামলা—মামলা ও মব আক্রমণের মাধ্যমে কখনও ঘৃণিত, কখনও আধা—ঘৃণিত, আবার কখনও নির্দোষ ব্যক্তিদেরও ধরে ধরে আক্রমণ অব্যাহত আছে। কিন্তু একটি দলের সব সদস্য—সমর্থক যে সমান অপরাধী ছিলেন না— সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। নানা রকম মিথ্যা ট্যাগ লাগিয়ে বাক্—ব্যক্তি—সংগঠনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা আইনসংগত হবে না। এর ফলে ভীতি ও অনিশ্চয়তা ফিরে আসবে ও এসেছে। আগামীতে ত্রয়োদশ নির্বাচন করতে হবে এবং কাদের নিয়ে তা হবে— এটি নিয়ে এই অনিশ্চিত অবস্থা যত দ্রুত কমিয়ে একটি অবাধ সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক আবহাওয়া তৈরি করা যাবে, ততই গণতন্ত্র বিপদমুক্ত, অংশগ্রহণমূলক হবে। 

‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে বর্ধিত জনকল্যাণ, বৈষম্য হ্রাস ও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেই এই অন্তর্বর্তী সরকারকে নিজেদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হবে। কোনো কোনো মহলের অতিক্ষমতায়ন ও তার অপব্যবহার এবং চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা অসাম্প্রদায়িক সম—অধিকারভিত্তিক ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের অভীষ্টের পথে অন্তরায়। সাধারণ মানুষ যেন সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তের সুফল পেতে পারে, সে উদ্যোগ নিতে হবে। সমস্যা সমুদ্র সমান কিন্তু আমরা আশা করি আলো আসবেই।



You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

সম্পর্কিত খবর

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য