বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও বাজারব্যবস্থা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন বহির্বিশ্বের কাছে গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে বিশ্বরাজনীতিতে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশে^র সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে।
বহুপাক্ষিকতাবাদে দৃঢ় বিশ্বাসী বাংলাদেশ জাতিসংঘে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরব ভূমি দখলের বিরুদ্ধে, ইউক্রেনের সংঘাতে মানবিক সহায়তাবিষয়ক দ্বিতীয় রেজল্যুশনে বাংলাদেশের স্পষ্ট ভূমিকা লক্ষণীয়। তবে দেশের রোহিঙ্গা সংকট, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ব্যাপক সামরিক আধুনিকায়ন ও পারমাণবিকীকরণ এবং মিয়ানমারের পরিমিত সামরিক আধুনিকীকরণসহ ভারত—চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সুসম্পর্ক এবং বর্ধিত সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও আধুনিকায়নের আগ্রহকে তৈরি করেছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশের সঙ্গে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার মতো বড় শক্তির সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতার চুক্তি রয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনেও বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতি বহুমুখী চাপের মধ্যে রয়েছে। চলতি অর্থবছরেও অর্থনীতি চাপে থাকবে বলে সম্প্রতি পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তের চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও বৈশ্বিক খাতের চাপ। আবার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রবৃদ্ধি হলেও তা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে খুব একটা ভূমিকা রাখেনি। এ ছাড়া বর্তমানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও রয়েছে। এসব কারণে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমে চলতি অর্থবছরে ৪ শতাংশে নামবে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস আমলে নিয়ে অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি রাখা প্রয়োজন বলে বিশ্লেষকদের অভিমত। বাংলাদেশে গত দুই বছরেরও অধিক সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। রাশিয়া—ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে সফল হলেও বাংলাদেশ তা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনতে পারেনি। যেখানে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কাও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পেরেছে। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, নেপালও এ তালিকায় রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এর অন্যতম কারণ অর্থ পাচার, চাঁদাবাজি ও শক্তিশালী বাজার সিন্ডিকেট। সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা নিত্যপণ্যের বাজারে। বাজারদর সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। ছোট হয়ে এসেছে মানুষের খাদ্যগ্রহণের তালিকা। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২৪—এ অনুযায়ী, ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতার দিক থেকে ১২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। এ অবস্থা আরও অবনতি হবে যদি এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়। সার্বিক মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও স্ফীত হবে। বাজারে শৃঙ্খলা না থাকলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যবসায়িক পরিবেশের ওপর, যা পক্ষান্তরে বাজারব্যবস্থায় আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। সরকারকে শক্ত হাতে বাজার সিন্ডিকেট দমন করে বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। নয়তো মানুষের ওপর আর্থিক বোঝা বাড়তে থাকবে, যার প্রভাব পড়বে সামষ্টিক অর্থনীতিতে।
ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগ নিচ্ছে বর্তমানে তা ভালো দিক। কিন্তু ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ওপর মানুষের যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে তা দূর করা প্রয়োজন। সংস্কার ও সুশাসন ছাড়া ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার, আর্থিক সংস্থার ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে না। অর্থনৈতিক সংকটের সময় জনগণের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা পেতে তাদের আস্থা থাকাটা জরুরি। দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর মাধ্যমে অন্তভুর্ক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হওয়া জরুরি। প্রবৃদ্ধির সুবিধার যদি ন্যায্য বণ্টন না হয় তা বৈষম্য প্রকট করে তোলে। আর দেশে বৈষম্য এখনই চরম পর্যায়ে রয়েছে। তাই বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ দরকার। বেসরকারি খাতের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বাড়াতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। দেশে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। এরপর রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে আইনের দ্রুত প্রয়োগের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মাত্রাতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ, দুর্বল অবকাঠামো ও গ্যাস—বিদ্যুৎ সংকট, জমির অভাব ও ক্রয়ে জটিলতা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ জোগানে সক্ষমতার অভাব এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যোগসূত্র ও সমন্বয়ের অভাব। উপরন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সুশাসনের অভাবও রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এখন থেকেই সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। বহির্বিশ্বির অস্থিরতার প্রভাবও দেশে ব্যাপক হারে পড়তে পারে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে পারে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। এতে রিজার্ভ ক্ষয় আরও ত্বরান্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার জ্বালানি আমদানি বাধাপ্রাপ্ত হলে জ্বালানি নিরাপত্তায় টান পড়বে। এর প্রভাব পড়বে শিল্প উৎপাদনে। এসব বিবেচনায় নিয়েই অগ্রসর হতে হবে, প্রস্তুত হতে হবে শক্তভাবে সংকট মোকাবিলার জন্য।
বর্তমানে আমরা বৈশ্বিক মেরুকরণের নতুন ধারা দেখতে পাচ্ছি, যা বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করে। দুই আঞ্চলিক শক্তি ভারত—চীনের বাংলাদেশকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সামরিক প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থরক্ষার নীতিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আর নিঃসন্দেহে বহির্বিশ্বেও এর প্রভাব পড়েছে। তাই বৃহৎ ও পরস্পর বৈরীভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যালেন্স অব পাওয়ার ও ব্যালেন্স অব রিলেশন বজায় রেখে বহির্বিশ্বের সঙ্গে পারস্পরিক শান্তি ও প্রগতি অর্জন করবে। চীন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, অবকাঠামো প্রকল্পে প্রচুর বিনিয়োগ করছে। বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠলে নেপাল, ভুটান ও পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও রপ্তানি সম্পর্কিত কিছু সুবিধা বাতিল হবে, তাই সময় ও অর্থনৈতিক কূটনীতির সঠিক ব্যবহার করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখা খুবই প্রয়োজনীয়।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?