স্লোগানটা উঠেছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই; ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে– এ সমাজ ভাঙতে হবে, নতুন সমাজ গড়তে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাম ঘরানার রাজনৈতিক কর্মীরাই ছিল এ স্লোগানের প্রবক্তা। কিন্তু সমাজ ভাঙার কাজটা তারা করতে পারেনি। এক পর্যায়ে বরং সমাজ ভাঙতে গিয়ে নিজেরাই ভেঙে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেছে। অন্যদিকে বুর্জোয়ারা সমাজ পরিবর্তনকে ভয় পায়। মনে করে, সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হলে তাদের ক্ষমতার মসনদও টলে উঠবে।
৫৩ বছর ধরে এমনটিই চলে আসছে। এই সময়ে অনেকবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে– কখনও শান্তিপূর্ণভাবে, বেশি সময়ই অভ্যুত্থান বা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের কথা কেউ বলেনি। ফলে বাইরে আলো জ্বললেও ভেতরে রয়েই গেছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারই প্রতিফলন দেখা যায় প্রতিদিনের খবরে। ধর্ষণ, বলাৎকার, খুন, গণপিটুনি, শিক্ষক হেনস্তা এখন মুড়ি-মুড়কির মতো হয়ে গেছে। অনেকেই এসবকে নিছক রাজনৈতিক বা আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক সমস্যা বলে চালিয়ে দিতে চান। কিন্তু কিছু বিষয় আছে, যেসবের শিকড় সমাজের অনেক গভীরে প্রোথিত। এই যেমন গৌরনদী উপজেলার বাটাজোড় ইউনিয়নের ১০ বছরের শিশু মাহি হত্যার বিষয়। দৈনিক সমকালের ৩০ ডিসেম্বরের খবরমতে, ১০ বছরের শিশু মাহিকে তিনজন দুর্বৃত্ত ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে রাখে। জানা যায়, শিশুটি ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী; মা নেই, বাবা দিনমজুর। ১৪ ডিসেম্বর বাড়ির পাশে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। সেখান থেকেই খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে পাশের একটি বাগানে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। পরে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশটি পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। এ তো সাধারণ এবং স্বাভাবিক কোনো অপরাধ নয়। চূড়ান্ত বিচারে এটি অবক্ষয়িত সমাজেরই প্রকাশ। দৈনিক সমকালের ২৯ ডিসেম্বরের আরেক খবরমতে, ফরিদপুরে চোর সন্দেহে মিল্লাত চৌধুরী (৩১) নামে এক যুবককে পিটুনি দিয়ে হত্যা করে স্থানীয় কিছু লোক। গত ২৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে গেরদা ইউনিয়নের গেরদা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। হতে পারে নিহত ব্যক্তি কোনো অপরাধ করেছিল। কিন্তু গণপিটুনি দিয়ে কাউকে মেরে ফেলা কোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ হতে পারে না। এদিকে কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে মারধরের পর রহমান সায়ান নামে এক যুবক অপমানিত বোধ করে নিজ ঘরে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এর আগের রাতে চুরির অভিযোগে স্থানীয় এক নেতা তাঁকে মারধর করেন। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনি নিজ ঘরের তীরের সঙ্গে মাফলার পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন (সমকাল, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪)।
অহরহ এমন ঘটনা ঘটছে। ক’দিন আগেই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে। এ নিয়ে সারাদেশে নিন্দার ঝড়ও উঠেছে।
এদিকে গত বছর আগস্ট অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর ‘পদত্যাগে বাধ্য’ করার দুই মাসের মাঝে ২২ ডিসেম্বর হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন চট্টগ্রামের বেসরকারি হাজের-তজু ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ এস এম আইয়ুব। জানা যায়, গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে ‘এক দল লোক’ হাজেরা-হজু ডিগ্রি কলেজে অবস্থান নেয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় কিছু শিক্ষার্থী। সেদিন তারা উপাধ্যক্ষ আইয়ুবের পদত্যাগসহ আরও তিন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের বরখাস্তের দাবি তোলে। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে বেঞ্চে শুয়ে পড়েন উপাধ্যক্ষ এস এম আইয়ুব। এর পর ‘আন্দোলনকারীদের লেখা’ একটি পদত্যাগপত্রে তাঁর আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। সেদিন কলেজটির অধ্যক্ষ চয়ন দাশকেও অবরুদ্ধ ও মারধর করা হলে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে দিয়ে অন্য তিনজন শিক্ষকের বরখাস্ত আদেশেও জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এই ঘটনার পর আর কলেজে যাননি উপাধ্যক্ষ আইয়ুব। তবে মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। অবশেষে হার্ট অ্যাটাক করে পৃথিবী থেকেই বিদায় নিলেন। এগুলো কেবল সাম্প্রতিক বিষয় নয়। গত সরকারের আমলেও, ২০২২-এর জুন মাসে নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের ওপর ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কিছু লোক জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছিল। ঘটনার সূত্রপাত একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে কলেজের এক ছাত্র ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়। পরদিন ওই ছাত্র কলেজে গেলে কিছু মুসলমান ছাত্র তাকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলে। ওই সময় অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের ‘পক্ষ নিয়েছেন’– এমন রটিয়ে পড়লে সেখানে উত্তেজনা তৈরি হয়। উত্তেজিত ছাত্ররা অধ্যক্ষ ও দু’জন শিক্ষকের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কলেজের কিছু ছাত্র ও স্থানীয় লোকজন স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়।
প্রায় একই সময়ে (২৫ জুন ২০২২) সাভারের আশুলিয়ায় উৎপল কুমার নামে এক কলেজ শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করেছিল তাঁরই এক ছাত্র। জানা যায়, নিহত শিক্ষক ছিলেন কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান। তিনি মেয়েদের যৌন হয়রানির কারণে খুনি ছাত্রকে শাসন করেছিলেন। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নিতে শিক্ষককে পিটিয়ে খুন করেছে ছাত্রটি।
ওপরে যে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, তার বাইরেও প্রতিদিন কোথাও না কোথাও এ জাতীয় ঘটনার খবর পাওয়া যায়। ছাত্রের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছনা তো আজকাল ডালভাত।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর শুরু হয়েছে তুচ্ছ অভিযোগে গণপিটুনিতে হত্যা। হঠাৎ গোটা সমাজ যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন? আসলে সমাজে পুঁজির দৌরাত্ম্য যখন বেড়ে যায়, মূল্যবোধে তখন ধস নামে। কয়েক দশক ধরে আমাদের সমাজে ঠিক এমনটিই ঘটে চলেছে। কিন্তু কেউই একে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে দিন দিন একটা ভয়াবহ রকমের সামাজিক অবক্ষয় আমাদের গ্রাস করতে চলেছে। এতে ইন্ধন জোগাচ্ছে পুঁজিবাদী ধারার অসুস্থ রাজনীতি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ক্ষমতার মোহে এ জাতীয় কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহিতও করছে। আসলে বর্তমানে রাজনৈতিক আর সামাজিক অবক্ষয় একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে এগিয়ে চলেছে।
স্বাধীনতার পর এ দেশে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, সবাই দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে। কেউই সামাজিক উন্নয়নের দিকে নজর দেয়নি। ফলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে সর্বনাশা অসুস্থতার ঘুণ; ভেঙে পড়ছে আমাদের শতাব্দীপ্রাচীন মূল্যবোধের কাঠামো। এখন তা প্রায় ক্যান্সারে রূপ নিতে যাচ্ছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এর মেরামত দরকার। আর মেরামত করতে গেলে প্রথমেই ভেঙে ফেলতে হবে পচা-গলা এই সমাজ ব্যবস্থা। বাধা আসবে, তবে একে ভাঙতে হবেই– আজ হোক বা কাল।
লেখক: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?