clock ,

সংকুচিত হচ্ছে শ্রমবাজারও

সংকুচিত হচ্ছে শ্রমবাজারও

২০২৪ সালে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য একগুচ্ছ অঙ্গীকার, উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়েই এলো বিষাদের খবর। অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ‘বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের গতিপ্রকৃতি ২০২৪শীর্ষক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাংলাদেশিদের জন্য ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে বিদেশের শ্রমবাজার। জাল কাগজপত্র, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে গত বছরই বেশকিছু দেশে শ্রম অভিবাসন বন্ধ হয়েছে। বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজ করছেনএমন প্রচারণা থাকলেও বাংলাদেশি কর্মীদের অভিবাসন মূলত কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর সিংহভাগ অভিবাসী উপসাগরীয়, অন্যান্য আরব, পূর্ব দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ১২১৩টি দেশেই যাচ্ছেন। গত পাঁচ বছরে ৯৭ শতাংশ কর্মী গেছেন মাত্র ১০টি দেশে। গত বছরে ৯০ ভাগ বাংলাদেশি কর্মী অভিবাসিত হয়েছেন মাত্র ছয়টি দেশে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লাখ হাজার ৩৫৫ জন পুরুষ নারী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সৌদি আরবেই গেছেন ৬০ ভাগ কর্মী ( লাখ ৪১ হাজার ৬৯৮ জন) এছাড়া মালয়েশিয়ায় ১০ দশমিক ৩০ ভাগ (৯৩ হাজার ৩৫৬ জন), কাতারে দশমিক ৫৬ ভাগ (৬৮ হাজার ৫৩০ জন), সিঙ্গাপুরে দশমিক ৭৬ ভাগ (৫২ হাজার ১৭৫), আরব আমিরাতে দশমিক ২০ ভাগ (৪৭ হাজার ১৪৩ জন) জর্ডানে দশমিক ৫৪ ভাগ (১৩ হাজার ৯২০ জন) কর্মী গেছেন। পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতোই গত বছরও জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সর্বাধিকসংখ্যক নারী কর্মী সৌদি আরবে অভিবাসিত হয়েছেন (৩৫ হাজার ৫৩৮ জন) এছাড়া জর্ডানে গেছেন হাজার ১২৪ জন। কাতার, যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাত, কুয়েত, হংকং, জাপানেও নারীরা অভিবাসিত হয়েছেন। তবে হংকং, জাপান ইত্যাদি দেশে যাওয়া নারী কর্মীর সংখ্যা নগণ্য। ওমান, বাহরাইন, মালদ্বীপসহ বেশ কয়েকটি দেশে বছর কোনো অভিবাসন ঘটেনি। ইতালিতে জাল কাগজপত্রের কারণে সার্বিয়ার আবেদন প্রক্রিয়ার সার্ভার অকেজো হওয়ায় দেশগুলোয় শ্রম অভিবাসন কার্যক্রম থেমে আছে।

প্রতারণার মাধ্যমে ভিসা বাণিজ্য করে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কর্মী পাঠানোর কারণে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে করে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) রামরু জানায়, স্বল্পদক্ষ তথা অদক্ষ শ্রমিক অভিবাসনের হার ২০২৩ সালের তুলনায় শতাংশ বেড়েছে। ২০২৪ সালে যারা কর্মের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন, তাদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ২৩ শতাংশ (চার লাখ ৯১ হাজার ৪৮০ জন) স্বল্পদক্ষ শ্রমিক। হার ২০২৩ সালে ছিল ৫০ শতাংশ। এছাড়া, অভিবাসীদের মধ্যে দশমিক ৫৯ শতাংশ ছিলেন পেশাজীবী, ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ দক্ষ, এবং ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ আধাদক্ষ শ্রমিক। জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে ১০ হাজার ৩৪৭ কর্মী গেলেও গত বছর তা কমে হয়েছে হাজার ৫০৮। ইতালিতে ২০২৩ সালে ১৬ হাজার ৯২৬ কর্মীর কর্মসংস্থান হলেও গত বছর মাত্র হাজার ১১২, যা ৯৪ শতাংশ কম। বৈধ পথে ইতালিতে অভিবাসনের সুযোগ কমায় ভূমধ্যসাগর দিয়ে মানব পাচার বেড়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে ওমান। সরকারি পর্যায়ে দেনদরবারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি উচ্চ আয়ের পর্যটক, পেশাজীবীসহ কয়েকটি খাতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলেও কর্মী নিতে রাজি নয়। গত মে মাসে বন্ধ হয় বহুল আলোচিত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ইরাকের শ্রমবাজার বন্ধ হয় ২০১১ সালে, ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ বাহরাইনের শ্রমবাজার, চালুর মাস পর বন্ধ হয়ে গেছে মালদ্বীপের শ্রমবাজার। কর্মসংস্থানের কারণে জনশক্তি রপ্তানির বৃহৎ বাজার দেখালেও সেখানে যাওয়া কর্মীদের একটি বড় অংশ কাজ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনে নিষিদ্ধ হলেও কর্মীপ্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায়ভিসা কেনাহচ্ছে।ভিসা কিনতেদেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে; আবার সৌদি আরব থেকেও আসছে না প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স।

ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আগস্ট শেখ হাসিনার পতনে ক্ষমতায় আসে . মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। জনশক্তি ব্যবসায়ীরা আশায় ছিলেন, নোবেলজয়ীর ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়ানো যাবে। প্রধান উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্টরা বক্তৃতায় প্রবাসীদের গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললেও, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোগ দেখা যায়নি। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকায় এসে . ইউনূসকে পাশে নিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, নির্ধারিত সময়ে তাঁর দেশে যেতে না পারা ১৭ হাজার বাংলাদেশি নিয়োগ পাবেন। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে একজনও যেতে পারেননি। আগস্টসেপ্টেম্বরের ধসের পর অক্টোবর নভেম্বরে লাখের বেশি কর্মী বিদেশ গেছেন। তবে তাদের ৮০ শতাংশের বেশি গেছেন সৌদি আরবে।

মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের দফা

রিক্রুটিং এজেন্টদের দেওয়া অর্থ ফেরত না পাওয়া সহ দফা দাবীতে গত ২৯ ডিসেম্বর প্রবাসী কল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুরা। তারা জানান, গত ৩১ মে মালয়েশিয়া প্রবেশের শেষ সময় হলেওএজেন্সি অজানা কারণে তাদের সেদেশে পাঠাতে পারেনি। এর মধ্যে একাধিকবার সরকারের পক্ষ থেকে টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও অনেকেই টাকা ফেরত পায়নি। অভিযোগ জানানোর পরও এর কোন সুরাহা হয়নি।


তাদের সাত দফা দাবিগুলো হলোটাকা দিয়ে দুই বছর সময় পার করেও মালয়েশিয়া যেতে পারিনি, আমরা আর মালয়েশিয়া যেতে চাই না, আমাদের টাকা ফেরত চাই; সিন্ডিকেটের ১০০ এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করে মালিকদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে, এবং বিদেশে পলাতক মালিকদের পাচার করা টাকা বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিগ্রস্তদের দিতে হবে; কর্মীদের সমস্যার সমাধান না করে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ রাখা; রিক্রুটিং এজেন্সির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা ট্রাভেল এজেন্ট, সাব এজেন্ট দালালদের অবিলম্বে গ্রেফতার; মন্ত্রণালয় বিএমইটিতে অভিযোগ করার মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও নিস্পত্তি না হওয়ার ব্যাখ্যা; দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধে নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় সরকারি কোন ব্যাংকে জমা নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্ষতিপূরণ আদায় করে না দিতে পারলে সরকারকে ব্যর্থতার দায় গ্রহণ এবং সরকারি খরচে প্রত্যেককে মালয়েশিয়া ছাড়া অন্য যেকোনো দেশে বিনা খরচে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।

ব্লক রিজেক্টেদিশাহারা সিঙ্গাপুর গমনেচ্ছুরা

সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন কোম্পানিতে একের পর এক চাকরির আবেদন করে পাসপোর্ট ব্লক রিজেক্টের কারণে দিশাহারা সিঙ্গাপুর ফেরত প্রবাসী গমনেচ্ছুরা। গত ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সিঙ্গাপুর ফেরত প্রবাসী গমনেচ্ছুরা শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে অংশ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, আমরা  ইঈঅ স্কিল প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছি এবং এখানে উপস্থিত অনেকেই সিঙ্গাপুরে পূর্বে // বছর যাবত কাজ করেছেন। কেউ ছুটিতে এসেছেন, কারো কোম্পানির কাজ নেই, কেউ আবার নতুন কোম্পানিতে জয়েন করবেন। কিন্তু দেশে ফিরে এসে অন্য কোম্পানিতে যখনই আবেদন করছেন তখনই রিজেক্ট আসছে। আবার নতুন যারা সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্যই লক্ষধিক টাকা খরচ করে স্কিল অর্জন করেছেন। তারাও কোন কোম্পানিতে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। আমাদের আবেদনগুলো কেন রিজেক্ট হচ্ছে সে সংক্রান্ত কোন জবাবদিহিতাও আমরা পাচ্ছি না। সিঙ্গাপুর ফেরত ভুক্তভোগীরা বলেন, কোনো এজেন্সির মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পরে কোম্পানির মালিক সেইফটি কোর্স করার জন্য তার দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। প্রশিক্ষণ শেষে কর্তৃপক্ষ আমাদের সার্টিফিকেট দেওয়ার পর আমরা যখন অন্যত্র জমা দেই তখন দেখা যায় সেই সার্টিফিকেটটি জাল এবং ভুয়া। সঙ্গে সঙ্গে তারা পাসপোর্ট ব্লক করে আমাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়। ফলে বিভিন্ন কোম্পানিতে আবেদন করেও MOM (Ministry of Manpower)) কর্তৃক আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে।


নির্ধারিত ট্রেনিং সেন্টার থেকে স্কিল অর্জন করে সিঙ্গাপুরে চাকরির আবেদন করতে গিয়ে ২০১২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই সমস্যায় পড়েছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণ নিয়েও বেকারত্ব থেকে মুক্তি মিলছে না। মানববন্ধন আয়োজনের প্রধান সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা জানি সিঙ্গাপুর একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ। তাই আমরা এত কিছু না বুঝে কোম্পানি যেভাবে কাজ করতে বলে সেভাবে করি। কিন্তু আমরা যে ধেঁাকার শিকার হব তা কখনও ভাবিনি। সিঙ্গাপুর সরকারও ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরা যারা সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসেছি তারা মানবেতর জীবন যাপন করছি। এনজিও, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে, জমি বিক্রি করে স্কিল অর্জন করে তবে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঋণ পরিশোধের আগেই দেশে ফিরতে হচ্ছে। নতুনভাবে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ। আমাদের কেউ সিএনজি চালিয়ে, দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছে। যদি কোনো কারণে আমাদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর সরকারের কোনো অভিযোগ থাকে বা আমাদের কোন ভুল হয়ে থাকে, তবে আমরা সিঙ্গাপুর সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমরা প্রতিশ্রম্নতি দিচ্ছি যে, ভবিষ্যতে সঠিক নিয়ম মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আমরা শ্রমিকবান্ধব সিঙ্গাপুর সরকারের সকল ধরনের শর্ত পূরণ করে কাজ করতে চাই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আকুল আবেদন কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করে আমাদের সিঙ্গাপুরে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। তা না হলে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ নেই আমাদের।

ভুক্তভোগী নাসিম আহমদ বলেন, কোম্পানির  ধোকায় পড়ে আমরা আজ নিঃস্ব। আমাদের সরকার যদি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে তাহলে ভালো একটি সমাধান আশা করা যায়। সমাবেশে উপস্থিত ভুক্তভোগীদের সবাই প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যাতে পাসপোর্ট রিজেক্ট, ব্লক এর বিষয়ে সিঙ্গাপুর সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানপূর্বক প্রত্যাগত এবং গমনেচ্ছুদের সিঙ্গাপুরে প্রবেশের জন্য সহযোগিতা করে এই শ্রমবাজারটিকে ধংসের হাত থেকে রক্ষা করা হয়। তারা বলেন, আমরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি যে, আপনার মাধ্যমে এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান সম্ভব। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো। সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি জমা দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ কি ধরনের পদক্ষেপ নেন সেটা আমরা দেখবো। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরে যারা রিজেক্ট বা পাসপোর্ট ব্লকের শিকার হয়েছেন তাদের নিয়ে দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন, আলমগীর আহসান, রবিউল ইসলাম প্রমুখ।

ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় শ্রমবাজার খোঁজার কথা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বহু বছর ধরে বললেও, পরিসংখ্যান অনুযায়ী এসব দেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা নগণ্য। ২০২৩ সালে হাজার ৯৫৬ কর্মী রোমানিয়া যাওয়ার ছাড়পত্র নেন। গত বছর তা কমে হয়েছে হাজার ৫২৮। লাখ টাকায় পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে কর্মী পাঠায় রিক্রুটিং এজেন্সি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজেন্সি সরাসরি নয়, দালালের মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করে। গত তিন বছরে রোমানিয়া থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। তাই নতুন ভিসা দিচ্ছে না দেশটি। বাংলাদেশ থেকে রোমানিয়া কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ায় দেশটির ভিসা নিতে হয় দিল্লি থেকে। আগস্টের পর ভারত ভিসা বন্ধ করায়, রোমানিয়ার ভিসার জন্য দিল্লি যেতে পারছেন না কর্মীরা। একই অবস্থা ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড ক্রোয়েশিয়ার। ২০২৩ সালে পোল্যান্ড যেতে ছাড়পত্র নেন হাজার ৬৬ কর্মী; গত বছর ২০২। গত বছরে ১২ হাজার ৫২১ কর্মী কিরগিজস্তান যেতে ছাড়পত্র নিয়েছেন। ২০২৩ সালে নিয়েছিলেন হাজার ৭২০ জন। জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মধ্য এশিয়ার এই দেশটিতে হাজার হাজার কর্মী যাচ্ছেন মূলত ইউরোপে ঢোকার প্রলোভনে। প্রতিশ্রুত চাকরি এবং বেতন নিশ্চয়তার জন্য বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য অন্যতম সেরা শ্রমবাজার দক্ষিণ কোরিয়া জাপান। ভাষাগত কাজের দক্ষতার পরীক্ষা নিয়ে দেশ দুটি কর্মী নিয়োগ করে। ২০২৩ সালে ১০ হাজার কর্মী নিয়োগের কোটা দিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া, গিয়েছিল হাজার ৪৯৬। গত বছর গেছেন হাজার ৯১৮ জন। বছর শেষে নানান হতাশার মধ্যেও একটি সুখবর শোনা যাচ্ছে তাহলো ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমিরাতের ভিজিট ভিসা চালু হচ্ছে। সেই সঙ্গে বন্ধ থাকা কর্মসংস্থান বা ওয়ার্ক ভিসা চালুরও ইঙ্গিত মিলেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে ভ্রমণ ভিসা এমনকি অভ্যন্তরীণ ভিসা পরিবর্তনেরও সুযোগ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। সমস্যা দ্রুত সুরাহার আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আলী আল হামুদি। রাষ্ট্রদূত জানান, বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা সংক্রান্ত সমস্যা দ্রুত সুরাহার হবে। জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারিতে ভিসা চালুর সম্ভাবনা রয়েছে।

বিএমইটির পক্ষ থেকে ৫৩টি দেশের শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর সম্ভাবনা নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছে ২০১৮ সালে। এরপর আর কোনও গবেষণা হয়নি। অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নতুন সম্ভাবনাময় বাজার ধরতে না পারলে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে দেশের অভিবাসন খাত। প্রবাসী কল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বন্ধ থাকা শ্রমবাজার নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। জর্ডান মরিশাসের সঙ্গে কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। আশা করা যাচ্ছে খুব শিগগিরই ব্রুনাইয়ে কর্মী যাবে। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুবিভাগ থেকে শ্রমবাজারের সমস্যা নিরসনে করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা চেষ্টা করছেন এসব বাজার উন্মুক্ত করতে। তিনি ইতোমধ্যে বাজার খোলার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছেন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজের কোঅর্ডিনেটর . মো. জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ায় অভিবাসীরা শোষণের শিকার হন। ভুয়া কাগজপত্র দাখিল, নিয়োগে অনিয়ম, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়সহ নানা কারণে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করেছে। আবার যেসব দেশে খোলা আছে সেগুলোরও কোনও কোনোটিতে রফতানি কমছে। সরকারিবেসরকারি খাতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ে দেশে বিদেশে যেসব গবেষণা হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। ফলে ইউরোপে বিভিন্ন খাতে দক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা ঠিক কতখানি এবং ভবিষ্যতে এই চাহিদার কোনও পরিবর্তন হবে কিনা, সম্পর্কে নেই কোনও পরিসংখ্যান।

বেতন বঞ্চিত প্রবাসী কর্মীদের মালয়েশিয়ায় বিক্ষোভ

মালয়েশিয়ায় কলিং ভিসায় কাজ নিয়ে কাওয়াগুচি কোম্পানিতে নিয়োগ পান অসংখ্য বাংলাদেশি শ্রমিক। কোম্পানিটি কর্মীদের ঠিকমতো বেতন না দিয়ে তাদেরকে নির্যাতন করতো। বিষয়টি নিয়ে হাইকমিশনও একাধিকবার কোম্পানির কতৃর্পক্ষের সাথে আলোচনায় বসে। সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ান ট্রেডস ইউনিয়ন কংগ্রেসের (এমটিইউসি) প্রতিনিধি এথায়াকুমার শ্রমিকদের পক্ষে এবং কাওগুচির প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। মালয়েশিয়ার শ্রম অধিদপ্তর (জেটিকেএসএম)—এর একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে, জাপানি ইলেকট্রনিক্স প্রতিষ্ঠান সনি, প্যানাসনিক এবং ডাইকিনের প্লাস্টিক উপাদান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কাওয়াগুচি ম্যানুফ্যাকচারিং এসডিএন বিএইচডি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধে সম্মত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২৫১ জন বাংলাদেশি কর্মীর জন্য প্রায় ৩০ লাখ রিঙ্গিত পরিশোধ করবে।


মালয়েশিয়ায় কাওয়াগুচি ম্যানুফ্যাকচারিং এসডিএন বিএসডি কোম্পানিতে কর্মরত ৩০০ বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান বিষয়ক সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। নিয়ে গত ৩০ ডিসেম্বর একটি নোটিশ জারি করেছে হাইকমিশন। নোটিশে বলা হয়েছে, গত ১৮ ডিসেম্বর দেশটির ডিপার্টমেন্ট অব লেবার (জেটিকে) কোর্টের নির্দেশনা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ ডিসেম্বর ১৬০ কর্মীকে দেশটির ৭টি স্থানে নতুন কোম্পানির অধীনে হাই কমিশনের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এবং ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের মাধ্যমে নিয়োগকর্তা পরিবর্তনপূর্বক হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই ১৬০ কর্মীর মধ্যে কেওয়াইবিইউএমডব্লিউ মালয়েশিয়া এসডিএন বিএইচডিতে ১০ জন, সারিকাত পারনিয়াগান কেমাজুয়ান এসডিএন বিএইচডিতে ৪৫ জন, উইন উইন ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ এসডিএন বিএইচডিতে ২০ জন, ইকোশপ মার্কেটিং এসডিএন বিএইচডিতে ৪১ জন, সিইভিএ লজিস্টিকস এসডিএন বিএইচডিতে ১৭ জন, ডেসারু দামাই বীচ রিসোর্ট এসডিএন বিএইচডিতে ১০ জন এবং ক্যামেরন হাইল্যান্ডেসের বিখ্যাত চা উৎপাদনকারী কোম্পানি বোহ টিতে ১৭ জন কর্মীকে স্থানান্তর করা হয়েছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম শ্রমশক্তি রপ্তানিকারক সপ্তম বৃহত্তম রেমিট্যান্স প্রাপ্ত দেশ হওয়া সত্বেও বিদেশে আটক, বহিষ্কার এবং শোষণ প্রবাসীদের জন্য গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রামরু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী কাজ হারানো, নিয়োগকর্তার খারাপ আচরণ অথবা অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশের কারণে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেশে ফিরে আসছেন। ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের পরিসংখ্যান সম্ভবত ১০ মিলিয়নেরও বেশি, কিন্তু যারা অনানুষ্ঠানিক পথে দেশ ছেড়ে যান, তাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহের উপায় নেই। এই কারণে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় পথ দিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমাতে যাওয়া অনথিভুক্ত অভিবাসীদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন কারণেবিশেষত মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। শরিফুল হাসান অভিবাসীদের ফিরে আসার সময় বিপত্তি মোকাবিলায় বিমানবন্দরে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এসব ব্যক্তিরা প্রায়ই বিভিন্ন মানসিক এবং শারীরিক অবস্থায় ফিরে আসেনকেউ শোষণ, অত্যাচার বা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন, আবার কেউ গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এমনও রয়েছেন যেখানে ব্যক্তি তাদের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন এবং পরিবারের সদস্য বা ঠিকানা মনে করতে পারছেন না। তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। আমাদের বিমানবন্দরে এসব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে এবং সংবেদনশীলভাবে মোকাবিলা করার জন্য নির্দিষ্ট বিভাগ এবং অবকাঠামো থাকা উচিত। ধরনের প্রচেষ্টা সুশৃঙ্খলভাবে হওয়া উচিত, যেখানে সরকারের এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম নিশ্চিত করবে, যাতে এসব ব্যক্তিকে সম্মান সহায়তার সঙ্গে পুনরায় সামাজিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়।

আর্থিক সংকটে সব দেশেই কর্মসংস্থান কমছে। জনশক্তি ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে নতুন শ্রমবাজার খুঁজছেন না আবার চরমান বাজারগুলোতেও রয়েছে মনিটরিং এর অভাব। আবার দক্ষ কর্মী না থাকায় বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশনির্ভর। এসব দেশে ভিসা কেনাবেচা, প্রতারণা, নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের কয়েক গুণ টাকা আদায়সহ নানা অনিয়ম হয়। একদিকে নতুন শ্রমবাজার তৈরিতে সরকারকে  যেমন উদ্যোগ নিতে হবে তেমনি বিদেশে দক্ষ কর্মী সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলেই বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ, চাঙ্গা হবে দেশের অর্থনীতি।

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য