নারী- একটি শব্দ, যা শক্তি, সংগ্রাম, ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। বহুল পরিচিত এক বাক্য রয়েছে- ‘দিবসগুলো পালিত হয় অথচ শপথগুলো নয়।’ প্রত্যেক নারী দিবসে একটি করে নতুন স্লোগান ওঠে। আবার কালের নিয়মে সেটা মিলিয়ে যায়। সেই পুনর্মুষিক ভব! নারী দিবস নিয়ে যতই আলোচনা হোক, বিশ্বের কোনও না কোনও প্রান্তে নারীরা প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হন। এখনও ভ্রূণহত্যা হয়। অন্ধকারে একটু আশার আলো দেখলেও আবার অমাবস্যার অন্ধকার সব ঢেকে দেয়। মৃত্যু হয় বহু নারীর, মরতে হয় বহু মাতৃগর্ভে ভ্রূণে থাকা শিশুকে। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পাইনি। জানি না, এর শেষ কোথায়? কিন্তু সমাজকে তো নিজের কর্তব্য ভুলে গেলে চলবে না। শুধু নারী দিবস বলে নয়, আমি চাই, নারীরা আরও বেশি করে নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝুক। নিজেদের বিষয়ে আরও সচেতন হোক। আরও বেশি করে নারীত্বের উদযাপন করা হোক। সমাজে নারীসম্মান আরও বেশি করে গুরুত্ব পাক। সম্মানকে কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে? সেই বিষয়টির উপর আরও আলোকপাত হওয়া জরুরি।
ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বেও নারীরা কিন্তু আজ অনেক পারদর্শী। আমাদের দেশের নারীরা সর্বক্ষেত্রে নিজেদের অস্তিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। জীবনের ধ্বজা উড়িয়ে তাঁরা বারবার বলেছেন- ‘আমি নারী। অবমাননার পাত্রী নই। আমি ধরিত্রী মায়ের মতো সহ্য ক্ষমতা রাখি। আমি যতটা আবেগপ্রবণ, ততটাই ভয়ঙ্করী, আবার প্রয়োজনে ক্ষমাশীল।’ তবে দুঃখের, কোথাও গিয়ে তাঁকে হার স্বীকার করতে হয়। তাঁকে প্রতিটা মুহূর্তে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে লড়তে হয়। এ এক আজব টানাপোড়েন। সফল হওয়ার পাশাপাশি কখনও তাঁকে অসফলও হতে হয়। অন্দরের যন্ত্রণাকে মুড়ে রেখে আবার তাঁকে ময়দানে নামতে হয়। আমি বলি কী, নারীকে বাকরুদ্ধ করা যায়। মুখে লাগাম পরানো যায় কিন্তু তার ভিতরের বুলেট কখনও হার মানে না। নারী অসীম।
এই প্রথম নারী দিবসে মা নেই। নাড়ির টান যেন ছিঁড়ে গেল। সদ্য মাকে হারিয়েছি। তাই যন্ত্রণাটা বুকে বাজে। মা মানেই এক পৃথিবী। মা মানেই তো সমুদ্র। মা মানেই গর্ভ। তাই মায়ের শূন্যতা অপূর্ণ। আমার কাছে অপূরণীয় ক্ষতি। সেটার সঙ্গে যুঝতে খুব কষ্ট হয়। নারীদিবস উপলক্ষে আমাদের ‘পুরাতন’ ছবিটার কথা বলব। মা-মেয়ের গল্প অবলম্বনে তৈরি এই ছবিতে গভীর কিছু মুহূর্ত রয়েছে। যেখানে সম্পর্কের সমীকরণ খুব সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে। সেদিক থেকেই এই ছবিটা আমার কাছে খুব প্রিয় হয়ে থাকবে। আফশোস হয়, মাকে দেখাতে পারলাম না ‘পুরাতন’। কিন্তু তাতে কী? আমার শান্তি, পৃথিবীতে আরও কত মায়েরা রয়েছেন, যাঁরা এই ছবিটা দেখবেন এবং মা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন, ভালোবাসার জায়গাটার সঙ্গে একাত্ম হতে পারবেন। এই ছবির সুবাদে চোদ্দো বছর পর আবার শর্মিলা ঠাকুর বাংলা সিনেমায়। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে দারুণ একটা উপহার হতে চলেছে ‘পুরাতন’। ওঁর মতো অভিনেত্রীকে পেয়ে আমরা আপ্লুত। অদ্ভূত সুন্দর মানুষ। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। কাজ, সংসার নিপুণ হাতে সব যিনি সামলেছেন। নিঃসন্দেহে সব প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণা উনি। একজন নারী হিসেবে, মা হিসেবে নারীদিবসে ওঁকেও কুর্নিশ জানাতে চাই।
আমাদের সিনেইন্ডাস্ট্রিতে খুব সুন্দর একটা সমতা রয়েছে। নারী দিবসে কলম ধরার সুবাদে সেই প্রসঙ্গটাও এই পরিসরে উল্লেখ করতে চাই। অনেক ক্ষেত্রেই নায়ক না নায়িকা, কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এমন ‘সুপ্ত’ তর্ক-বিতর্ক, চর্চা চলে। আমার মতে, এখানে যে যাঁর মতো সম্মান পান। উল্লেখ্য, হিরোইনরা অনেকসময় হিরোদের ঊর্ধ্বে গিয়ে সম্মান পান বা অনেকসময় একই ছবিতে নায়ক-নায়িকাদের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়। এই ইন্টারেস্টিং ইকুয়েশনটা শব্দে প্রকাশ করে বোঝানো যাবে না। একটি ছবিতে যে নায়িকাদেরও সমান অবদান থাকে, তা অনস্বীকার্য। হয়তো পারিশ্রমিকের মাপকাঠিতে কমবেশি হয়, তবে আমি এটাও জানি অনেক নায়িকারা অনেক নায়কদের থেকে বেশি পারিশ্রমিক নেন। সবক্ষেত্রে হয়তো এক হয় না। তবে পারিশ্রমিকের থেকেও বড় কথা আমার যেটা মনে হয়, তাদের ক্ষমতা, অভিনয়, প্রেজেন্টেশনের জায়গাটাও অনেক সুন্দর হয় যখন তারা নিজেদেরকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারে। অনেকসময় হিরোরা ম্লান হয়ে যায় সেখানে। আবার অনেক সময় ম্লান না হয়ে একটা সুন্দর সামঞ্জস্য তৈরি হয়। শুধু সিনেইন্ডাস্ট্রি বলে নয়, ঠিক এই সমতাটাই আমাদের সকলের জীবনে দরকার। এই সমতা বা সমমর্যাদাটা বজায় থাকলে সবকিছুই একটা সিস্টেমেটিক পথে চলবে। কারণ অসমতার কারণেই ‘স্ট্রং’ এবং ‘উইক’ এই পার্থক্যটা হয়ে আসছে অনেক বছর ধরে। আর সেই কারণেই সবসময় দুর্বলের উপর শক্তিশালীরা একটা অত্যাচার করে। যদি দুজনের পারদর্শিতাকেই সম্মান করা যায়, তাহলে পৃথিবীটাও অন্যরকম হয়। নারী-পুরুষ মিলেই তো এই জগৎসংসার।
শেষপাতে পুরুষদের উদ্দেশে একটা কথা বলতে চাই, ভিতরের নারীকে যে পুরুষ স্পর্শ করতে পারে সেই আসল, সেই আদর্শ। নারীদের সম্মান করতে জানতে হবে আগে। অন্দরের মানুষটিকে স্পর্শ না করতে পারলেও, পুরুষ যদি নারীকে সম্মানের জায়গাতেও রাখে কিংবা সম্মান দিয়ে তাকে ভালোবেসে তার জন্য আলাদা একটা জায়গা তৈরি করে, তাকে দূরে না ঠেলে দেয়, তাহলেও কিন্তু ভীষণ সুন্দর একটা সমীকরণ তৈরি হয়। আমার একটাই কথা, যে পুরুষরা নারীদের সম্মান দেয়, নারীদের কদর করে কিংবা মনে করে, নারীরা ওতপ্রোতভাবে তাঁদের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের আমি সত্যিই খুব শ্রদ্ধা করি।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?