clock ,

বাজেট স্বচ্ছতা এবং এলডিসি থেকে উত্তরণ; অন্তর্বর্তী সরকারের সতর্ক হওয়ার সময় এখনই

বাজেট স্বচ্ছতা এবং এলডিসি থেকে উত্তরণ; অন্তর্বর্তী সরকারের সতর্ক হওয়ার সময় এখনই

প্রতিটি রাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ গঠনের রূপরেখা তৈরি করে একটি বার্ষিক বাজেটের মাধ্যমে। উন্নয়ন হবে, শিক্ষা স্বাস্থ্য এগোবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এসব স্বপ্নই বাজেটের পাতায় প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সরকার একটি সময়োপযোগী সম্ভাবনাময় বাজেট প্রস্তাব করেছে। বাজেটের মূল প্রতিশ্রুতি হলো বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষিতে আধুনিকায়ন এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো গঠন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আজকে স্থানীয় প্রশাসন এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, যেখানে অরাজনৈতিক শক্তি কিছু ছদ্ম-রাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। নির্বাচন না হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু মনে করছে এবং প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করছে। ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং থানার ওসিদের অনেকেই সরাসরি অভিযোগ করেছেনতাদের ওপর রাজনৈতিক পরিচয়ধারী কিছু ব্যক্তি নির্দেশ-উপদেশ দিচ্ছে, টেন্ডার বা নিয়োগে হস্তক্ষেপ করছে, এমনকি চাঁদাবাজি জমি দখলের মতো গুরুতর অপরাধে লিপ্ত থাকছে। এই পরিস্থিতি শুধু আইনের শাসনকে বিপন্ন করছে না, বাজেটের যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো মাঠে বাস্তবায়নের কথা সেগুলোও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন অর্থহীন। আর বিশৃঙ্খলার ভেতরে সুশাসন বজায় রাখা সম্ভব নয়।

সরকার যে উন্নয়নমুখী বাজেট দিয়েছে, তাতে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে তরুণদের জন্য স্টার্টআপ ফান্ড, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যে ভর্তুকি এবং শিক্ষাখাতে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দএসবই অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। একটি সুপরিকল্পিত বাজেট তখনই সার্থক, যখন মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা তার বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত থাকে। যদি মাঠপর্যায়ে প্রশাসন দুর্বল হয়, যদি আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক চাপ বা অদৃশ্য প্রভাবের কাছে নতিস্বীকার করে, যদি স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, দলীয়করণ বিশৃঙ্খলা চলতে থাকে তাহলে এসব বাজেট বরাদ্দ কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কোনো বাস্তব সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে না।

প্রশ্ন হলো এই পরিস্থিতিতে দোষটা কার? একটি নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক সরকার হয়ে কীভাবে তারা প্রশাসনের ভেতরে এই ছদ্ম-রাজনৈতিক প্রভাবকে সহ্য করছে? সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনকে রক্ষা করা, অরাজনৈতিক শক্তিকে থামানো এবং উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, বাজেট বাস্তবায়নের জন্য একটি সময়ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ কাঠামো গঠন করা উচিত, যাতে বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা, তা নিয়মিত মূল্যায়ন করা যায়।

এবার আসা যাক জনগণের প্রত্যাশায়! এই দেশ যাদের জন্য, তাদের চাওয়া কী? খুব বেশি কিছু নয়। নিরাপদ জীবন, সেবা পাওয়ার অধিকার, সন্তানের পড়াশোনার নিশ্চয়তা, অসুস্থ হলে সরকারি হাসপাতালে ভরসা, এবং কাজের সুযোগ এইটুকুই। মানুষ বাজেট পড়ে না, কিন্তু বাজেটের প্রভাব তারা বুঝতে চায়। তারা চায়, সরকার যা বলেছে তা যেন ঘটে। তারা চায়, দখলদার না, দায়বদ্ধ প্রশাসন। তারা চায়, প্রতিশ্রুতির বদলে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। আমরা ভুলে যাইবাজেট যতই চমকপ্রদ হোক, শৃঙ্খলা না থাকলে সব পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে। আবার, শৃঙ্খলার জন্য শুধু পুলিশি ব্যবস্থা নয়প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসনের কাঠামো এবং প্রশাসনের পেশাদারিত্ব। এই তিনের সমন্বয়েই বাজেট সফল হবে, উন্নয়ন টেকসই হবে এবং জনগণ সত্যিই উপকৃত হবে।

২০২৪-২৫ অর্থবছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাতে এক অনন্য সাফল্যের নজির স্থাপন করেছে। মাত্র ১০ মাসে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে ২৫.২৭ বিলিয়ন ডলারযা দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ। গত মে মাসের প্রথম ১৭ দিনেই এসেছে ১৬১ কোটি ডলার (প্রায় ১৯,৬৪২ কোটি টাকা) রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্বস্তি দিয়েছে, অন্যদিকে বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীদের আস্থা সরকারের নীতির কার্যকারিতার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। বাজেটের মাধ্যমে প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, বিনিয়োগ এবং পুনর্বাসন সুবিধা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। বাজেটে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পর্যাপ্ত কার্যকর বরাদ্দ থাকলে তাদের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং তারা দেশের উন্নয়নে আরও বৃহৎ পরিসরে অবদান রাখার সুযোগ পায়। বিশেষ করে, তাদের কষ্টার্জিত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রয়োজন আর্থিক সচেতনতা কর্মসূচি, সাশ্রয়ী বিনিয়োগ সুযোগ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের সম্প্রসারণ।

২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করিবে। এটি নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের অন্যতম বড় আর্থ-রাজনৈতিক স্বীকৃতি। বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের যে আর্থ-সামাজিক উত্তরণ ঘটেছে দারিদ্র্য হ্রাস, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, শিক্ষার বিস্তার মানব উন্নয়নে অগ্রগতি এই অর্জন তারই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তবে এই গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক যেমন জাতীয় আত্মবিশ্বাসের উৎস, তেমনি এটি একটি নতুন বাস্তবতারও সূচনা। তাই এটি নিয়ে এই মুহূর্তে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ, উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ এমন একটি বাস্তবতায় প্রবেশ করছে যেখানে প্রতিযোগিতা কঠিনতর, এবং স্বচ্ছ নীতিকাঠামো টেকসই অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছাড়া উন্নয়ন বজায় রাখা দুরূহ।

বহুদিন ধরেই ব্যবসায়ী মহল এবং অর্থনীতিবিদরা গ্র্যাজুয়েশন পেছানোর পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল রফতানি অগ্রাধিকার হারানো, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির চাপ এবং বাণিজ্য সুরক্ষা হ্রাসের বাস্তবতায় দ্রুত উত্তরণ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে হুমকিতে ফেলবে। বিশেষত পোশাক খাত, যা একাই বাংলাদেশের রফতানির ৮৪ শতাংশ বহন করে, বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের জন্য ডাবল ট্রান্সফরমেশন রুলস, সেফগার্ড ক্লজ, এবং জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার কঠিন শর্তাবলি বড় বাধা হতে পারে। যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়া অগ্রাধিকার বজায় রাখলেও কানাডা, চীন, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে পরবর্তী বাণিজ্য সম্পর্ক এখনও অনিশ্চিত। বিপরীতে ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া ইতোমধ্যে আঞ্চলিক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশকেও অবিলম্বে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং জিএসপি-পূর্বাবস্থার বিকল্প কৌশল খুঁজে বের করতে হবে। তদুপরি, দেশের অবকাঠামো এখনো রফতানি প্রতিযোগিতার জন্য পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত নয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ, বন্দর ব্যবস্থাপনা কাস্টমস সংস্কারে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে। রফতানিমুখী ক্ষুদ্র মাঝারি কারখানাগুলোর জন্য সাশ্রয়ী অর্থায়ন প্রযুক্তিগত সহায়তা এখন সময়ের দাবি। এই বাস্তবতায় সরকারকে দ্রুত একটি গ্র্যাজুয়েশন রেসপন্স টাস্কফোর্স গঠন করেবাণিজ্য কূটনীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন, পণ্য বৈচিত্র্যকরণ এবং অর্থনৈতিক সংস্কারকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। একই সঙ্গে মানবসম্পদ উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।

বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের গর্বিত গন্তব্যে পৌঁছেছে, এখন পরীক্ষার সময় এই অর্জনকে কীভাবে টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে রূপান্তর করা যায়। তা নির্ভর করবে প্রস্তুতি, দূরদর্শিতা এবং কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের নিরপেক্ষতা। এই নিরপেক্ষতার বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো প্রশাসনকে অপ-রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করা, বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আর্থিক অবকাঠামো সুসংহত করা।

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য