‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলাভাষা!।’ প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে আসে একুশে ফেব্রুয়ারি সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে। কিন্তু দেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে একুশ নতুন আবেদন নিয়ে ধরা দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয় সারা পৃথিবীতে আমাদের মননের বাতিঘর হিসেবে। একুশ এখন সারা বিশ্বের ভাষা ও অধিকারজনিত সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক। বিশ্ব জুড়ে বাংলাদেশিদের অভিবাসনের কারণেই বিভিন্ন দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অহংকার ‘শহীদ মিনার’। এই অমর শহীদ মিনারের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে মুক্তিকামী মানুষ প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারিতেই দুর্জয় শপথ গ্রহণ করে—শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অঙ্গীকার, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা অবসানের অঙ্গীকার, স্বৈরাচার অনাচার ধ্বংসের অঙ্গীকার।
যে বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করে অর্জিত হয়েছে বিশ্বের বুকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা ও অহঙ্কার—সেই মাতৃভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত আজও থামেনি। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরও রাজপথে নামতে হচ্ছে এ প্রজন্মকে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে। তাই কবি শামসুর রাহমানের সাথে সুর মিলিয়ে আক্ষেপ করে বলতে হয়—“তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,/বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা। ” সুখের বিষয় বাংলা ভাষার পবিত্রতা সর্বদা রক্ষার লক্ষ্যে— বাংলা ভাষার বিকৃতি চলবে না— এই মর্মে বাংলাদেশের হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন এবং আরো একটি রায়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড, গাড়ির নম্বর ও নেইমপ্লেটে বাংলাভাষা ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে এর ফলাফল কতটা প্রভাববিস্তারকারী সেটা সহজেয় অনুমেয়। বহির্বিশ্বে ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ, সেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি শিক্ষার্থী বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহির্বিশ্বে ভারত ও বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। কলম্বিয়া, লার্গাডিয়াসহ আমেরিকায় কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই যেখানে বাংলাদেশি জনবসতি স্থাপিত হয়েছে সেখানেই বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। অভিবাসী বাংলাদেশি সমাজ সেখানে একটি ‘বাংলাদেশ’ তৈরি করেছে। বাংলা ভাষাপ্রেমী অভিবাসী সমাজের নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসা না থাকলে কখনোই এই অর্জন সম্ভব হতো না। অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারি। এবার বইমেলায় তুলে ধরা হয়েছে জুলাই—আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের নানা দিক। ছিল ‘জুলাই চত্বরও’।
আমরা এই বিশেষ দিনে অভিবাসী বাঙালি সমাজের সবার কাছে আবেদন রাখছি—আসুন আগে নিজের ঘর থেকে শুরু করি নিজ নিজ সন্তানদের সঠিক বাংলা শিক্ষা চর্চা। তাহলেই বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অর্জন সার্থকতা পাবে। অমর একুশের চেতনাকে ধারণ করে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হোক, বৈষম্যহীন বর্ণিল পৃথিবী গড়ে উঠুক— শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?