১২ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। হ্যাকার হানায় বিপর্যস্ত ক্রিপ্টোকারেন্সির দুনিয়া। এ যাবৎ সবচেয়ে বড় ডাকাতি। ক্রিপ্টোকারেন্সি সংস্থা বাইবিট জানিয়েছে, হ্যাকারেরা নিরাপত্তার ফাঁকগুলিকে কাজে লাগিয়ে ১০৫ কোটি ডলারের ডিজিটাল মুদ্রা সরিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে। সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে হ্যাকারেরা ইথেরিয়াম নামের মুদ্রাটি ডিজিটাল ওয়ালেট থেকে চুরি করেছে। নানা রকম ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে। যেমন— বিটকয়েন, লাইটকয়েন, ইথেরিয়াম, রিপ্ল, জিক্যাশ, ড্যাশ। বিটকয়েনের পরে মূল্যের দিক থেকে ইথেরিয়াম হল দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিপ্টোকারেন্সি।
বাইবিট একটি প্রধান ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ। এক্সচেঞ্জ সংস্থাগুলির মাধ্যমে ক্রিপ্টো মুদ্রা কেনাবেচার কাজ চলে। ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই বাইবিটের সিইও বেন ঝো এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করে বিবৃতি দেন। তিনি জানান বাকি সমস্ত ওয়ালেটগুলি নিরাপদে রয়েছে। হ্যাকিংয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ার ফলে অনেকেই তাঁদের ক্রিপ্টোকারেন্সি তোলার জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করে দিয়েছেন। সে কারণে এই লেনদেনের জন্য অপেক্ষার সময়সীমা বৃদ্ধি পেতে পারে। তিনি সমস্ত বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে বলেন যে হ্যাক হওয়া ক্রিপ্টো উদ্ধার না হলেও সংস্থার বিশেষ ক্ষতি হবে না।
বাইবিটের প্রতিষ্ঠাতা জানান, এই চুরি যাওয়া অর্থ সংস্থা অথবা অংশীদারদের থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে মেটানো যেতে পারে। বর্তমানে বাইবিটের ২ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে। বাইবিটের এই আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে রাখার ক্ষমতা রয়েছে বলে সমাজমাধ্যমে ঘোষণা করেছেন তিনি।
হ্যাকিংয়ের ঘটনার প্রভাব পড়েছে মুদ্রার দামেও। শুক্রবার ইথেরিয়ামের মূল্য প্রায় ৪ শতাংশ কমে যায়।এর ফলে প্রতি কয়েনের মূল্য ২,৬৪১.৪১ ডলারে পৌঁছেছে। ‘এলিপটিক’ এবং ‘আরখাম ইন্টেলিজেন্সে’র মতো ব্লকচেন সংস্থার মতে চুরি হওয়া ক্রিপ্টোটি বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত করার পর তা দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়।
বাইবিটেট ওয়ালেটে ঢুকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পিছনে কোন হ্যাকার বা হ্যাকারেরা জড়িত রয়েছেন সেই পরিচয় এখনও অজানা। একটি চেন অ্যানালিস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে গত বছর বেশ কয়েকটি বড়সড় হ্যাকের পিছনে হাত ছিল উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের।
ক্রিপ্টোকারেন্সি চুরি করা হ্যাকারদের একটি প্রিয় কৌশল। ব্রিটিশ ও মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদনেও একই দাবি তোলা হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারেরা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু দামি ক্রিপ্টো মুদ্রা চুরির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে এফবিআই এবং জাপানের জাতীয় পুলিশ সংস্থা একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে জাপানের একটি ক্রিপ্টো সংস্থা থেকে ৩০ কোটি ডলার চুরির জন্য উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের দায়ী করেছিল।‘এলিপটিকে’র বিশ্লেষকেরাও এই আক্রমণের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার ‘ল্যাজারাস গ্রুপে’র সম্পর্ক রয়েছে বলে সন্দেহ করেছেন। এটি উত্তর কোরিয়ার সরকার অনুমোদিত একটি হ্যাকিং গ্রুপ, যা ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে কোটি কোটি ডলার পাচারের জন্য কুখ্যাত। সরকারি তহবিলে যাতে অর্থাগম হয় সে কারণে নিরাপত্তার ফাঁক খুঁজে ক্রিপ্টোদুনিয়া থেকে কোটি কোটি টাকা হাপিস করে দেয় হ্যাকারেরা।
ল্যাজারাস গ্রুপের ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ বা প্ল্যাটফর্মগুলিকে তাক করে চলেছে ২০১৭ সাল থেকে । সেই সময় হ্যাকারদের এই দলটি দক্ষিণ কোরিয়ার চারটি এক্সচেঞ্জে অনুপ্রবেশ করে ২০ কোটি ডলার বিটকয়েন চুরি করে।
‘এলিপটিকে’র মতে সাম্প্রতিক বাই বিটের এই হ্যাকটি পূর্ববর্তী চুরিগুলিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২১ সালে পলি নেটওয়ার্ক থেকে চুরি হওয়া ৬০ কোটি ডলার এবং ২০২২ সালে ‘বিন্যান্স’ থেকে ৫০.৭ কোটি ডলারের হ্যাকিং।
ক্রিপ্টোকারেন্সি হল অনলাইন লেনদেনে ব্যবহারযোগ্য মুদ্রা। আর এক নাম ডিজিটাল কারেন্সি। ব্যবহার হয় সঙ্কেতলিপি বা এনক্রিপটন পদ্ধতিতে। লেনদেনকারীর পরিচয় জানা যায় না। সেই পদ্ধতিতেই তৈরি হয় মুদ্রার ইউনিট। এমনকি তহবিলের লেনদেনও। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন করতে হলে প্রথমে খুলতে হয় ওয়ালেট। এক জন একাধিক ওয়ালেটও খুলতে পারেন। ওয়ালেটে এই মুদ্রা জমা থাকে। যা রাখা যায় অনলাইনে, কম্পিউটারে, নেটমাধ্যমে ‘ভল্ট’ বা লকারে। লেনদেন করতে চাইলে ওই জমা ক্রিপ্টোকারেন্সিতেই পাঠাতে হয়।
এই ঘটনার পর বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো চুরি হওয়া ক্রিপ্টো মুদ্রাগুলি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। এলিপটিক-সহ অন্যান্য ক্রিপ্টো নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এক্সচেঞ্জগুলির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। হ্যাকারদের ক্রিপ্টো থেকে নগদ টাকা ভাঙিয়ে নেওয়া আটকাতে নজরদারি চলছে বলে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ঝুঁকি আছে জেনেও অল্প সময়ে বেশি মুনাফার জন্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ডিজিটাল মুদ্রা কেনার প্রবণতা বেড়েছে। এই ঘটনা আরও এক বার প্রমাণ করে দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের আরও সতর্ক হয়ে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?