clock ,

“বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে দ্বন্দ্ব: ঐতিহ্য না অপসংস্কৃতি?

“বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে দ্বন্দ্ব: ঐতিহ্য না অপসংস্কৃতি?

বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গমঙ্গল শোভাযাত্রাঘিরে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র বিতর্ক। দেশের খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা দাবি করছেনএই শোভাযাত্রা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অনেকেই একে ভারতীয়, বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক পৌত্তলিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং একটি সুপরিকল্পিত সাংস্কৃতিক প্রকল্প হিসেবে দেখছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রানামে পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রার প্রচলন তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক। এর সূচনা ১৯৮৬ সালে যশোরে এবং এরপর ১৯৯৬ সাল থেকে ঢাকায় মূলধারায় আসেতাওআনন্দ শোভাযাত্রাবাবর্ষবরণ শোভাযাত্রানামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় এটিমঙ্গল শোভাযাত্রাহিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সর্বশেষ ঘোষণা দিয়েছেএই নাম পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা নেই।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বলছেন, ‘মঙ্গলশব্দটি বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পরিচিত সাংস্কৃতিক শব্দ নয়। বরং এটি হিন্দু ধর্মীয় পুরাণভিত্তিকযেখানে মঙ্গল দেবতা রক্তবর্ণ বা অগ্নিবর্ণ এক পৌরাণিক চরিত্র। তার সঙ্গে যুক্তমঙ্গল প্রদীপ’, ‘মঙ্গল ঘটবামঙ্গল কাব্যধরণের শব্দগুচ্ছ বাংলা মুসলিম সংস্কৃতিতে আদৌ প্রচলিত নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক . মাহবুব উল্লাহ বলেন, “পেঁচা, সাপ, ময়ূর প্রভৃতি প্রতীকে সাজানো শোভাযাত্রা আমাদের সংস্কৃতি নয়, বরং পৌত্তলিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। এটি কোনোভাবেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটায় না।

সমালোচকদের মতে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রানামটি বাদ দিয়েনববর্ষ শোভাযাত্রা’, ‘বৈশাখী শোভাযাত্রাবাআনন্দ শোভাযাত্রানামকরণ করা যেতে পারে। একইসঙ্গে তারা শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত প্রতীক মুখোশগুলোর মধ্যেও পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, ধান, পাট, লাঙল, নদী বা নৌকাএসব বাংলাদেশের প্রাকৃতিক কৃষিভিত্তিক জীবনের প্রতীক। অথচ এসব অনুপস্থিতমঙ্গল শোভাযাত্রায়

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য . নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, “বাংলাদেশের সংস্কৃতি মানেই হিন্দু সংস্কৃতি নয়। এখানে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক চর্চার ইতিহাসও দীর্ঘ এবং তা স্বতন্ত্র। মঙ্গল শোভাযাত্রা সেই বাস্তবতা প্রতিফলিত করে না।

তবে সবাই যে একমত নন, সেটাও উঠে এসেছে। ইউট্যাব সভাপতি . এবিএম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, “এই শোভাযাত্রা কেউ ধর্মীয় উৎসব, কেউ সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে দেখে। আমি একে দেশীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই দেখি। নামকরণ পরিবর্তন করেবৈশাখী শোভাযাত্রাকরলেও মূল অনুষ্ঠানটির তাৎপর্য ঠিক থাকবে।

কবি হাসান হাফিজ বলেন, “সরকার এই শোভাযাত্রাকে সর্বজনীন করতে যে উদ্যোগ নিচ্ছে, তা ইতিবাচক। প্রয়োজন একটি সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি।

উল্লেখযোগ্য যে, ২০২৩ সালের এপ্রিল এক বাংলাদেশি আইনজীবীমঙ্গল শোভাযাত্রাবন্ধে আদালতে আইনি নোটিস পাঠান। তার যুক্তি—‘মঙ্গলশব্দটি একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতীক এবং শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত প্রতীকগুলো দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে।

বাংলা নববর্ষ দেশের একটি প্রাণবন্ত উৎসব। তবেমঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঘিরে বিতর্ক যেভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তা প্রমাণ করে সংস্কৃতি শুধুই উৎসব নয়এটি মূল্যবোধ, পরিচয় এবং ইতিহাসের ধারক। তাই এর কোনো অনুষঙ্গ যদি বৃহত্তর জনগণের বিশ্বাস ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনার দরকার রয়েছেনাম হোকমঙ্গলনাবৈশাখী’, তা যেন বিভাজনের বদলে ঐক্যের অনুঘটক হয়।

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য