অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের ও তাঁর প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছেন। যদিও দেড় দশকের স্বৈরাচারী শাসন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিবেচনায় আমাদের অনেক চাওয়া; কম রাজস্ব আয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ-স্বল্পতা ও সাহায্যপ্রাপ্তির ঘাটতি বিবেচনায় বড় বাজেটের সংগতি ছিল না। অতীতের অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পজনিত দুর্বলতাও এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে সংকোচনমূলক বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে, যা জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, যা ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক অনুদান থেকে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ ১২.২ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, করবহির্ভূত প্রাপ্তি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডবহির্ভূত কর ২ দশমিক ৪ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা পরিকল্পনায় ব্যাংক ঋণ, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশি ঋণ রয়েছে।
প্রস্তাবিত
বাজেটে জনপ্রশাসনে ২৩ দশমিক ৫
শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে
৫ দশমিক ৭ শতাংশ, প্রতিরক্ষায়
৫ দশমিক ২ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা
ও নিরাপত্তায় ৪ দশমিক ৩
শতাংশ, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে ১৪
শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৫ দশমিক ৩
শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে ৫
দশমিক ৭ শতাংশ, গৃহায়নে
শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, বিনোদন,
সংস্কৃতি ও ধর্মে শূন্য
দশমিক ৮ শতাংশ, জ্বালানি
ও বিদ্যুতে ২ দশমিক ৯
শতাংশ, কৃষিতে ৫ দশমিক ৯
শতাংশ, শিল্প ও অর্থনীতি সেবায়
শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, পরিবহন
ও যোগাযোগে ৯ শতাংশ প্রস্তাব
করা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত
বাজেটে সুদ পরিশোধে ১
লাখ ১৩ হাজার ৫০০
কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা
হয়েছে। আগামী অর্থবছরে বেতন-ভাতা ও
ভর্তুকির মতো খরচ চলতি
অর্থবছরের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে
অর্থ উপদেষ্টার প্রস্তাবিত বাজেটে। বাজেট ঘাটতি অতীতের মতোই জিডিপির ৫
শতাংশের নিচে রাখা হয়েছে।
আমরা অর্থ উপদেষ্টাকে বলতে
শুনেছি, ঋণের সুদ পরিশোধে
খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি
রাজস্ব আদায় কম হওয়ায়
বাজেটের আকার ছোট করতে
বাধ্য হয়েছে সরকার।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে
১ লাখ ২৫ হাজার
কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস
থেকে এবং ১ লাখ
১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক
উৎস থেকে নেওয়ার প্রস্তাব
করা হয়েছে। সুদ পরিশোধ বাবদ
ব্যয় ধরা হয়েছে ১
লাখ ২২ হাজার কোটি
টাকা।
অনেকেই বলেছেন, রাজস্ব আয়ের সক্ষমতা আর সম্ভাবনা বিবেচনায় আরও ছোট বাজেট হতে পারত। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আরও বরাদ্দ এবং সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী আরও বিস্তৃতির প্রয়োজন ছিল। হয়তো তাদের দাবি যৌক্তিক; কিন্তু ইতিহাস বলেম অতীতে এর সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অপচয়ের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের বরাদ্দের অর্থও ব্যবহার করতে পারছে না। প্রায় উদ্বৃত্ত কৃষি বিবেচনায় কৃষিক্ষেত্রেও বাজেটে নতুন করে নজর দিতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য গবেষণায় নতুন করে জোর দেওয়ার কথা নাই-বা বললাম।
আমাদের স্থানীয় বা বিদেশি দুই
সূত্র থেকেই আয় কম। অন্যদিকে
আবার গুণগত ও আকাঙ্ক্ষিত মান
বজায় রেখে ব্যয় করতেও
পারছি না। বাজেট নিয়ে
সংসদে যেমন খুব কম
আলোচনা হয়, তেমনি বাজেট
বাস্তবায়নেও নেই প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতা
ও জবাবদিহি। সুশাসনের দারিদ্র্য আমাদের যেন পিছু ছাড়ছে
না।
বাজেটে বরাবরের মতো এবারও মধ্যবিত্ত
ও উঠতি মধ্যবিত্ত তথা
ব্যক্তি খাতের চাকরিজীবী ও পেশাজীবীদের প্রত্যক্ষ
করের বোঝা অনেক বেড়েছে।
নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত নির্বিশেষে বেড়েছে পরোক্ষ কর তথা মূল্য
সংযোজন করের (ভ্যাট) বোঝা।
গণচীন,
ভারত, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো আর বাংলাদেশের মধ্যে
সম্প্রতি যে জায়গায় মিল
দেখা যাচ্ছে তা হলো মধ্যবিত্তের
বিকাশ। বিকাশমান মধ্যবিত্ত যেমন ভোগব্যয়কে উৎসাহের
মাধ্যমে পরোক্ষ কর বাড়ায়, তেমনি
তারা সমাজ ও অর্থনীতির
পরিবর্তনের কাণ্ডারি। সে কারণেই ভারত,
ইন্দোনেশিয়া এমনকি গণচীনও তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অধিকতর
ভোগব্যয়ে সক্ষম মধ্যবিত্ত বিশেষ করে উঠতি মধ্যবিত্তদের
নিয়ে এসেছে। ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার
বাজেটের মূল দর্শন বিবেচনায়
এটিকে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের এ বছরের বাজেট
বাস্তবায়নে মধ্যবিত্ত বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের
চাকরিজীবী ও পেশাজীবীরা যে
সংকুচিত হয়ে পড়বে, তাতে
সন্দেহ নেই। স্ল্যাব পরিবর্তন,
কর ও সম্পদ কর
বা কর সারচার্জ বৃদ্ধিতে
তাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ পড়বে।
সঞ্চয় ও ভোগব্যয় কমে
গিয়ে স্থানীয় ও পণ্যের বাজার
সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কর সারচার্জের লক্ষ্য
উচ্চবিত্তরা হলেও বাংলাদেশে দিনের
শেষে এটি চেপে বসছে
উচ্চ-মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী আর পেশাজীবীদের ওপর।
ভবিষ্যৎ বাজেট চিন্তায় যারা তাদের নিয়ে
আসবেন তারাই হয়তো দূরদর্শী বলে
বিবেচিত হবেন।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?