clock ,

বাগাড়ম্বর মানছে না বিশ্ববাসী

বাগাড়ম্বর মানছে না বিশ্ববাসী

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখনো ধারণা করছেন যে, গাজায় ধ্বংসলীলা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে তিনি বিশ্ববাসীর সমর্থন ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের জনগণদের সমর্থন আদায় তো দূরের কথা, বরং ইসরায়েলের অভ্যন্তরেই নাগরিকরা তার কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করেছে। বিবির পুরোনো ফাঁকা বুলির ওপর যে আর আস্থা রাখা উচিত নয়, তা ক্রমেই ইসরায়েলের অধিবাসীদের মনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

১৭ মাস ধরে নেতানিয়াহু নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো অগ্রাহ্য করে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মদদে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে, ফিলিস্তিনিদের দমন করার দোহাই দিয়ে তিনি এমনটা করতে সক্ষম হয়েছেন। জানুয়ারিতে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা ইসরায়েল একতরফাভাবে লঙ্ঘন করেছে। রমজান মাস, তাই সূর্যোদয়ের আগে সেহরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার অধিবাসীরা। এমন সময় শুরু হয় আকাশ থেকে বোমা হামলা। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সমগ্র গাজা উপত্যকার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে। এতে শত শত মানুষের প্রাণহানি আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

ইসরায়েল আর হামাস যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষর করে, তা কাতার মিশরের সরকারের পাশাপাশি, বাইডেন প্রশাসনের নিশ্চয়তায় কার্যকর হয়। পরবর্তীকালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনও চুক্তি বাস্তবায়নে আংশিকভাবে ভূমিকা রাখে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প বড়াই করে নিজেকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান নেপথ্য কারিগর হিসেবে কৃতিত্ব দাবি করেন। চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল যে, যুদ্ধের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে ইসরায়েল দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করবে। তবে নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও, ইসরায়েল আলোচনায় অংশগ্রহণে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

এমন সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো না গেলেও যুদ্ধবিরতি বহাল থাকবে এবং আটককৃতদের মুক্তি দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে না। কিন্তু ইসরায়েল এখন দাবি করছে যে, পাঁচজন জীবিত বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাবকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন প্রত্যাখ্যান করেছে। গত সপ্তাহে আমেরিকার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়ার পর, একজন ইসরায়েলি-আমেরিকান সেনাকে মুক্তি দিতে এবং দ্বৈত নাগরিকত্বধারী চারজন নিহত ব্যক্তির মরদেহ হস্তান্তর করতে সম্মত হয় হামাস। কিন্তু ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র একপাক্ষিকভাবে হামাসের সঙ্গে কূটনৈতিক চুক্তি করায় ইসরায়েলের সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। কারণে একজন ইসরায়েলি সেনার মুক্তির সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও লাগাতার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সব বন্দি ইসরায়েলি নাগরিকদের মুক্তি দাবি করছেন। কিন্তু হামাস স্বাক্ষরিত চুক্তি মেনে চলার কথা বলছে। তারা এখন পর্যন্ত চুক্তি লঙ্ঘন করেনি। ইসরায়েলের ভাষ্যমতে, তাদের সর্বশেষ আক্রমণের লক্ষ্য ছিল হামাসের নেতারা। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও আক্রমণের মূল শিকার হয়েছে অসহায় নারী শিশুরা। আমেরিকান গণমাধ্যম অ্যাক্সিওসের প্রতিবেদন মোতাবেক, যাদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে, তাদের অনেকেই ছিল হামাসের নিছক মাঝারি স্তরের নেতা। শীর্ষ পর্যায়ের কিছু হামাস নেতার নাম ইসরায়েল উল্লেখ করলেও, গত দেড় বছরে তারা যেসব হামাস নেতাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে, তাদের অনেককেই পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কর্তৃক আয়োজিত বন্দিমুক্তির সরাসরি টিভি সম্প্রচারের দরুন উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।

গাজায় যে শুধু একটা যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তা নয়, একই সঙ্গে এখানে দুটো ভিন্ন যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ব্যাপকসংখ্যক বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি, গাজার ২০ লাখ অধিবাসীর ওপর সমষ্টিগত শাস্তি আরোপ করা হচ্ছে। মার্চ মাসের তারিখ থেকে গাজা উপত্যকাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এমনটা করা সম্পূর্ণ অবৈধ। খাদ্য, পানি, ওষুধ বা অন্য কোনো প্রকার প্রয়োজনীয় সামগ্রী গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি গাজার একমাত্র সচল পানি পরিশোধনাগার চালু রাখতে যে বিদ্যুতের প্রয়োজন, সেই বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।

এই অনৈতিক অবরোধের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক কার্টন ডিমের দাম ছিল শেকেল, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯০ শেকেল। অর্থাৎ প্রতি ডিমের দাম এখন শেকেল বা প্রায় আমেরিকান ডলার। টমেটোর দাম ১০ শেকেল থেকে বেড়ে ৩০ শেকেলে পৌঁছেছে। রুটির একটা ব্যাগের জন্য তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পরও শেকেলের রুটি ১২ শেকেল দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। ২৫ কেজির যেই গমের বস্তা ২০ শেকেল দিয়ে কিনতে হতো, তার দাম এখন ৮০ শেকেল ছাড়িয়ে গেছে।

গাজার সাধারণ অধিবাসীদের পক্ষে এই চড়া মূল্য দিয়ে খাদ্যসামগ্রী কেনা আর সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অন্যায় অবরোধ আর হত্যাযজ্ঞের দরুন নীরবতা পালন করে মৌন সম্মতি দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, যিনি কি না নিজেকে যুদ্ধবিরোধী নেতা বলে জাহির করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তিনিও।

ইসরায়েলের এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে কী যৌক্তিকতা রয়েছে, তা ইসরায়েলের নাগরিকরা ভালো করেই জানেন, বিশেষ করে বন্দিদের পরিবারের সদস্যরা। অন্যদিকে সাবেক নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরযিনি জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর জোট সরকার থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেনএখন পুনরায় সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং গাজার ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূলের কথা বলছেন।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘আমি একবার প্রতারিত হলে দোষটা তোমার, কিন্তু একই কারণে আমি বারবার প্রতারিত হতে থাকলে দোষটা আমার।নেতানিয়াহু একবার নয়, নিরলস চেষ্টার মাধ্যমে বারবার বিশ্বকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে আশার কথা এই যে, বিশ্ববাসী এখন আর আগের মতো তার প্রপঞ্চে বিভ্রান্ত হচ্ছে না। তারপরও অধিকাংশ দেশ যুদ্ধাপরাধ বন্ধ করতে হয় অনিচ্ছুক নয়তো অক্ষম। এর প্রধান একটা কারণ হলোযুদ্ধ চলমান রাখার মেকি যৌক্তিকতার আড়ালে সত্য, ন্যায়বিচার আর যুদ্ধবিধ্বস্তদের আহাজারি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

 লেখক: আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। পুরস্কারপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক এবংস্টেট অব প্যালেস্টাইন নাউগ্রন্থের লেখক।

ভাষান্তর: অ্যালেক্স শেখ

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য