clock ,

দুর্ঘটনার ৪০ বছর পর ভোপালের বর্জ্য বিষ মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু

দুর্ঘটনার ৪০ বছর পর ভোপালের বর্জ্য বিষ মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু

সেটা ছিল ৪০ বছর আগের এক শীতের রাত, ১৯৮৪ সালের তেসরা ডিসেম্বরের দিবাগত রাত। মধ্যপ্রদেশের ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় বিষাক্ত গ্যাস লিক হয়েছিল সেই রাতে।

পরের ২৪ ঘণ্টায় ওই শহরের তিন হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যান বিষ বাষ্পে শ্বাস নিয়ে। সরকারি হিসাবেই সেই সংখ্যাটা পরবর্তী কয়েকদিনে ছুঁয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার এবং গত চার দশকে মারা গেছেন ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ।


অ্যাক্টিভিস্টরা অবশ্য বলেন যে মৃতের সংখ্যা ২৫ হাজারেরও বেশি এবং এত বছর পরেও ভোপালের মানুষ ওই গ্যাস লিকের জন্য নানা গুরুতর রোগে ভুগছেন।


মার্কিন মালিকানাধীন ইউনিয়ন কার্বাইডের কীটনাশক তৈরির ওই কারখানা থেকে সেইরাতে অন্তত ৩০ টন অতি-মারাত্মক রাসায়নিক মিথাইল আয়োসোসায়েনাইড গ্যাস লিক হয়ে গিয়েছিল।


বিশ্বের সবথেকে ভয়াবহ শিল্প-বিপর্যয়গুলির অন্যতম এই ভোপালের গ্যাস লিক।

সেই ঘটনার চার দশক পরে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শুরু হয়েছে ওই কারখানা চত্বরটিকে 'বিষ মুক্ত' করার কাজ।

ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জমে থাকা কয়েকশো টন বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেগুলি মধ্যপ্রদেশেরই ইন্দোরের কাছে একটি শহরে বিষাক্ত বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের একটি কারখানায় পাঠানো হয়েছে একরকম নজিরবিহীন নিরাপত্তা বন্দোবস্তের মাধ্যমে।

তবে যে কারখানায় ওই বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ হওয়ার কথা, সেই পিথমপুর শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন মানুষ।

শুক্রবার সকাল থেকে বহু বাসিন্দা রাস্তা অবরোধ করেন, দুজন বিক্ষোভকারী গায়ে আগুন দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন বলে ভোপাল থেকে বিবিসি সংবাদদাতা বিষ্ণুকান্ত তেওয়ারি জানিয়েছেন। তাঁদের অবশ্য জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় মানুষ বলছেন ভোপালের বিষাক্ত বর্জ্য কেন তাদের শহরে এনে পোড়ানো হবে?

যেভাবে বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হল

ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানা থেকে যে বিষাক্ত বর্জ্য সরানো হল, তার পরিমাণ ৩৩৭ টন। প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরে পিথমপুরের একটি বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বুধবার।

ভোপাল থেকে বিবিসির সংবাদদাতা বিষ্ণুকান্ত তিওয়ারি জানাচ্ছেন, "১২টি ট্রাকে করে এই বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ ওই ১২টি বর্জ্য-পরিবহনকারী ট্রাক সহ মোট ৪০টি গাড়ির কনভয় রওনা দেয়। পুরো রাস্তাটিকেই গ্রিন করিডর, অর্থাৎ কোথাও যাতে কনভয়টিকে লাল সিগনালে না দাঁড়াতে হয়, সেই ব্যবস্থা, করা হয়েছিল।"

প্রশাসন জানিয়েছে বিশেষ সতর্কতা নিয়েই বিষাক্ত বর্জ্য মাটি থেকে তুলে ফেলা হয়। এমনকি বর্জ্য যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানকার ধূলিকণাও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।


বিবিসি সংবাদদাতা বলছেন, "বর্জ্য পরিষ্কারের জন্য ৫০ জনেরও বেশি শ্রমিক নিযুক্ত করা হয়েছি। তাদের প্রত্যেকে পিপিই কিট (যেরকম পুরো শরীর ঢাকা পোষাক করোনার সময়ে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সদের পড়তে দেখা যেত) পড়ে ছিলেন এবং প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর শ্রমিকদের একেকটি দলকে বদলে ফেলা হচ্ছিল।"

মধ্য প্রদেশ গ্যাস পীড়িতদের ত্রাণ পুনর্বাসন বিভাগের কর্মকর্তা স্বতন্ত্র কুমার সিং বলেছেন, "শিল্প-বর্জ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এটাই ছিল সবথেকে কঠোর নিরাপত্তা প্রোটোকল। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে ওই বর্জ্য নষ্ট করে ফেলা হবে।"

 আদালতের নির্দেশে বর্জ্য অপসারণ

ভোপালের বাসিন্দা আলোক প্রতাপ সিং এই বিষ-বর্জ্য সরিয়ে ফেলার জন্য ২০০৪ সালে প্রথম মামলা দায়ের করেছিলেন। এরপরে ২০০৫ সালে ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানা থেকে বিষাক্ত বর্জ্য কী করে সরানো যায়, তা নিয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল গোটা প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে কী করে সম্পন্ন করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া।

অন্যদিকে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে ৩৪৫ মেট্রিক টন বিপজ্জনক বর্জ্য জড়ো করা হয়। মধ্য প্রদেশ হাইকোর্ট ওই বিষাক্ত বর্জ্য গুজরাতের আঙ্কলেশ্বরে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু গুজরাত সরকার আপত্তি তোলে।

এরপরে ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মধ্যপ্রদেশের পিথমপুরের একটি কারখানায় বর্জ্য জ্বালিয়ে ফেলার পরীক্ষা করা হয় সাতবার। সপ্তম শেষবারের পরীক্ষায় দেখা যায় বিষাক্ত বর্জ্য জ্বালানোর প্রক্রিয়াটিই সবধরনের পরিবেশগত-নিরাপত্তার মাপকাঠি পেরতে পারে।

পরীক্ষামূলক ভাবে পিথমপুরের ওই বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় প্রায় ১০ টন বর্জ্য জ্বালিয়েও ফেলা হয়। বাকি ৩৩৭ মেট্রিক টন বর্জ্য জ্বালিয়ে ফেলার জন্য রাজ্য সরকার ২০২১ সালে টেন্ডার আহ্বান করে। গতবছর জুলাই মাসে পিথমপুরের একটি বেসরকারি সংস্থাকে বিষ-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট ২০২৪ সালের চৌঠা ডিসেম্বর সরকারের প্রতি কড়া আদেশ দেয় যে চার সপ্তাহের মধ্যে ওই বর্জ্য সরিয়ে ফেলতেই হবে।

তড়িঘড়ি কাজে নামে সরকার এবং ২৯শে ডিসেম্বর থেকে বর্জ্য একত্র করার কাজ শুরু হয়।

পুরো প্রক্রিয়াটি সরকার গোপনীয়তার সঙ্গেই করছিল।

বিষাক্ত বর্জ্য কীভাবে জ্বালানো হবে?

পিথমপুর শহরে বিষাক্ত বর্জ্য নিয়ে যাওয়ার পর কী প্রক্রিয়ায় তা জ্বালিয়ে ফেলে নষ্ট করে দেওয়া হবে, তা নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ যেমন আছে, তেমনই সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আশঙ্কাও রয়েছে।

মধ্য প্রদেশ গ্যাস পীড়িতদের ত্রাণ পুনর্বাসন বিভাগের পরিচালক স্বতন্ত্র কুমার সিং বিবিসিকে বলছিলেন, "রাজ্যের শিল্প-কারখানাগুলি থেকে বেরনো রাসায়নিক এবং অন্য নানা বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের একমাত্র কেন্দ্রটি রয়েছে এই পিথমপুরেই। সেখানেই বিষাক্ত বর্জ্যও পুড়িয়ে ফেলা হয়।

"এই প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রটি কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দিকনির্দেশনায় চলে। আমরা ২০১৫ সালে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তত্ত্বাবধানেই সুরক্ষার দিকে সম্পূর্ণ নজর রেখে ১০ টন বর্জ্য সেখানে জ্বালিয়েছিলাম," বলছিলেন মি. সিং।

পুরো ভারতে ৪২টি এরকম প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র আছে যেখানে রাসায়নিক বিষাক্ত বর্জ্য নষ্ট করে ফেলা হয়। পিথমপুরের কেন্দ্রটি তারই অন্যতম।

সহজভাবে বললে, পিথমপুরের ওই প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পৌঁছনর পরে প্রথমে তা উচ্চ তাপমাত্রায় ইন্সিনারেটর বা ভাটিতে ফেলা হবে। সেখান থেকে নির্গত ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থেকেই বোঝা যাবে যে বর্জ্য জ্বালানোর পরে নির্গত ধোঁয়াতে বিপজ্জনক পদার্থ অবশিষ্ট আছে কী না।

বর্জ্য জ্বালানোর পরে যে অবশিষ্ট থাকবে, তার বেশ কয়েক পর্যায়ে পরীক্ষা করা হবে এবং যতক্ষণ বিপজ্জনক রাসায়নিক পাওয়া যাবে ততক্ষণ পুরো প্রক্রিয়া বারবার চালানো হতে থাকবে।

একেবারে শেষে যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে, তা মাটিতে পুঁতে ফেলা হবে।

এই পর্যায়ে মাটির অভ্যন্তর দিয়েই যাতে অন্য ভূমিস্তরে ওই বর্জ্যের শেষ অবশেষটুকু যাতে মিশতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

যে জায়গায় মাটিতে পোঁতা হবে, সেখানে 'ডবল কম্পোজিট লাইনার সিস্টেম' (দুটি প্লাস্টিকের স্তর এবং দুটি মাটির স্তরের মিশ্রণ) ব্যবহার করা হবে, যাতে মাটির ভেতরে বর্জ্যের শেষ অবশেষটুকুও না মিশতে পারে।

ভোপালের ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানা থেকে পিথমপুরে বিষাক্ত বর্জ্য স্থানান্তর এবং প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের একাংশের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

যে কারখানায় বর্জ্য জ্বালানো হবে, সেখানকার মানুষ এবং অ্যাক্টিভিস্টরা বিক্ষোভও দেখিয়েছেন।

একজন স্থানীয় বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, "প্রথমে তো এখানকার মানুষদের একটা কোনও নির্দেশনা দেওয়া হবে, তারপরে পুরো প্রক্রিয়া শুরু করা যেত।

"ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনার জন্য আমরাও গভীরভাবে দুঃখিত, কিন্তু সেরকম কিছু এখানেও আবার হবে না তো ! স্থানীয় মানুষদের তো কিছুই জানানো হয় নি। বর্জ্য জ্বালানোর ফলে যদি আমাদের কোনও সমস্যা হয় তাহলে আমরা কোথায়, কার কাছে যাব?" প্রশ্ন ওই বাসিন্দার।

এর আগে ২০১৫ সালে যখন পরীক্ষামূলক-ভাবে ওই জায়গায় বিষাক্ত বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ হয়েছিল, তখন মাটিতে, ভূগর্ভস্থ জলস্তরে এবং কাছাকাছি গ্রামগুলির পুকুরেও দূষণ ছড়িয়েছিল বলে দাবি করছেন অ্যাক্টিভিস্টরা। সরকার অবশ্য এইসব দাবি উড়িয়ে দিয়েছে।

যদিও 'ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর জাস্টিস ইন ভোপাল'-এর রচনা ধিংড়া বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসকে জানিয়েছেন বিষাক্ত বর্জ্য স্থানান্তরিত করা হলে আরেকটি 'স্লো-মোশন ভোপাল' ঘটবে।

তিনি এও বলছেন, ভোপালের মানুষ এখনও যে বিষক্রিয়ার ফল ভুগছেন, তার একটা অতি সামান্য অংশের বিষাক্ত বর্জ্যই কেবলমাত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছে।

"প্রায় ১১ লক্ষ মেট্রিক টন বিষাক্ত মাটি এবং বর্জ্য এখনও ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে বিষাক্ত করে চলেছে আর তার ফলে ভুগছেন ভোপালের হাজার হাজার মানুষ," ২০১০ সালের এক সরকারি সমীক্ষার প্রতিবেদন উল্লেখ করে জানিয়েছেন মিজ. ধিংড়া।

পিথমপুরার কাছাকাছি বড় শহর ইন্দোর। সেখানকার মেয়র এবং বিজেপি নেতা পুষ্পমিত্র ভার্গবও মনে করেন যে পিথমপুরায় ভোপালের বিষাক্ত বর্জ্য জ্বালানো উচিত হবে না এবং নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা করা দরকার।

বিবিসিকে তিনি বলেন, "গত কয়েকদিন ধরে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে কথা হচ্ছে। পিথমপুরার মানুষও বিরোধিতা করছেন। আমার মনে হয় বিষয়টা নিয়ে আরেকবার ভেবে দেখা দরকার যাতে পিথমপুরায় বর্জ্য না জ্বালানো হয়।

"বর্জ্য জ্বালানো হলে পিথমপুরার পরিবেশের ওপরে কী প্রভাব পড়বে, সেই তথ্যও প্রকাশ করা উচিত, আর সেটা আদালতেও পেশ করা উচিত যাতে কোর্ট একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে," বলছিলেন মি. ভার্গব।

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য