clock ,

  ব্রেকিং নিউজ
clock
দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতা রোধে ভারত যা করতে পারে

দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতা রোধে ভারত যা করতে পারে

গত ২০ নভেম্বর বিবিসি বাংলা নিউজ পোর্টালে খবর আসে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বিজেপি সরকার বাংলাদেশ লাগোয়া করিমগঞ্জ জেলার নাম বদল করে শ্রীভূমি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিলেটের জকিগঞ্জের ওপারে অবস্থিত করিমগঞ্জ শহরটি বাংলাদেশের সুরমা নদীর এপার থেকেই দেখা যায়। সুরমার এপার-ওপারের মানুষ একই ভাষায় কথা বলে। ১৯৪৭ সালের আগেও সিলেটের অংশ ছিল যে করিমগঞ্জ, সেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও বসবাস করে। তার পরও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ছলচাতুরীর সঙ্গে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলার ফল হিসেবে নদীর দুই পারের মানুষ দুই দেশে পড়েছে।

আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের চার বছর পর। ছোটবেলায় দিদিমা ও মায়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের করিমগঞ্জ, ধর্মনগর, শিলচরের মানুষ কীভাবে আমাদের সিলেট অঞ্চলের মানুষদের আশ্রয় দিয়েছিল; বর্ডার এলাকার ওই শহরগুলোতে যুদ্ধে তাদের অনেক মানুষ বোমা বর্ষণে মৃত্যুবরণ করেছিল, সেই গল্প প্রায়ই শুনে শিহরিত হতাম। সেই সময় থেকে ভারতের ওইসব অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের মানুষের সামাজিক সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছিল। কাঁটাতারের বেড়া বসানোর আগে দুপারের মধ্যে অবাধ যাতায়াতও ছিল। ছোটবেলায় আমি আমার দিদিমাকে অনেকবার ধর্মনগর, করিমগঞ্জ ও শিলচরে বেড়াতে যেতে দেখেছি। 

রবীন্দ্রনাথের এক ছোটগল্পে একজনের নাম ছিল ভূতনাথ। তাকে ভুল করে সতীনাথ ডাকায় সে খুব রাগান্বিত হয়েছিল। নিজের নাম তো বটেই, জন্মস্থানের নামও সাধারণত মানুষের মনে গভীর ভালোবাসা ও আত্মমর্যাদার জন্ম দেয়। কলমের খোঁচায় পাল্টে দেওয়া সেই ভালোবাসা ও মর্যাদাবোধকেই আহত করে। শত শত বছর ধরে স্থানীয়রা করিমগঞ্জ নামটা ব্যবহার করেছেন। নিছক সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কারণে তা পাল্টানো হলো। এমন না যে, করিমগঞ্জের নাম পাল্টানোর কোনো দাবি জনপরিসরে উঠেছিল। এটা বিজেপির সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি উস্কে দিয়ে পশ্চিম বাংলাসহ আশপাশের বাকি রাজ্যগুলোতে ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার নতুন চেষ্টা ভারতেরই পর্যবেক্ষকদের মত এটা। কিন্তু যে দেশ বাংলাদেশ ও তার অন্য প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা লালনের অভিযোগ তোলে, সে দেশের সরকার নিজেই একই কাজ করে কীভাবে?

উন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের শিখিয়েছে যে তারা কখনোই অন্য ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের যৌক্তিক অধিকারকে খর্ব করে না। তারা জানে, এটি করলে ভবিষ্যতে তার ভয়াবহ পরিণতি হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। তাই ক্ষমতায় তারা থাকলেও কল্যাণমুখী দায়িত্ব পালন করে জনগণের সেবক হিসেবে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ের ভারত অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে বলে অনেকেরই মত। অথচ সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে না দিয়ে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রীতির এক উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারত। এতে অন্য দেশগুলোর কাছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতো। বাংলাদেশসহ অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটা না করে বিজেপি নাম পাল্টানোর আলোচ্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ভোট নিজের বাক্সে নেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। আমার দৃষ্টিতে এটি ব্রিটিশ ভারতের সময়ের ঔপনিবেশিক বিভাজনের রাজনীতিরই একটি আধুনিক রূপ। এই রকম রাজনৈতিক চর্চা কীভাবে ভারতকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে এগিয়ে নিতে পারে? যদিও আজকের ভারত অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ইউরোপের অনেক আধুনিক ও উন্নত দেশকে ছাড়িয়ে গেছে; ইহজাগতিক বা সেক্যুলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, মানবাধিকার ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে উন্নত রাষ্ট্রের যে মানদণ্ড, তা কি অর্জন করতে পেরেছে? কোনো দেশ যদি তার মূল সমস্যা কৃষক ও শ্রমিকের জীবনমানের উন্নতি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সমাজে অসাম্প্রদায়িকতার প্রকৃত চর্চাকে উৎসাহিত না করে, তাহলে সেই রাষ্ট্র কখনও আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় উন্নত রাষ্ট্রের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে না।

জন্মসূত্রে দক্ষিণ এশিয়ার একজন নাগরিক হিসেবে আমি ভারত রাষ্ট্র ও তার জনগণকে এখনও আশা ও বিশ্বাসের আসনে রাখতে চাই, যেখানে অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও ভারত বজায় রাখবে তার অসাম্প্রদায়িক, বন্ধুভাবাপন্ন ও আঞ্চলিক সহযোগীর রাষ্ট্র-চরিত্র। আর তখনই ভারত প্রকৃতপক্ষে শুধু হিন্দুদের জন্য শ্রীভূমি না হয়ে তা হয়ে উঠবে সব ধর্ম ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের আশা-ভরসার তীর্থভূমি; বৈচিত্র্যময় ধর্মচর্চার একটি মহান দেশ; বৈচিত্র্য ও ভিন্নমতের মানুষের এক স্বপ্নের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। মানুষের প্রত্যাশা, আধুনিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত হবে এক উদাহরণ।
 
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

You Must be Registered Or Logged in To Comment লগ ইন করুন?

আমাদের অনুসরণ করুন

জনপ্রিয় বিভাগ

সাম্প্রতিক মন্তব্য